আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে এক বিশাল দানব আকৃতির ব্ল্যাকহোল। এর নাম, স্যাজিটারিয়াস এ-স্টার (Sagittarius A*)। এই অতিকায় ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪০ লক্ষ গুণ বেশি। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৬ হাজার আলোকবর্ষ। সুপারম্যাসিভ এই ব্ল্যাকহোলটি আবিষ্কার করার জন্য দু'জন বিজ্ঞানীকে ২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের নাম, এন্ড্রিয়া গেজ এবং রেইনহার্ড গেনজেল।
এই ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘুরছে একটি দ্রুতগামী নক্ষত্র, যার নাম S62। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে দ্রুতগতির তারা। যখন এটি ব্ল্যাকহোলের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন এর গতি হয় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৪,০০০ কিলোমিটার, যা আলোর গতির প্রায় ৮ শতাংশের মতো। এত দ্রুতগতিতে চলার ফলে এর জন্য সময়ের গতিও বদলে যায়।
আপেক্ষিকতার নিয়ম অনুযায়ী, যখন S62 এই বিশাল ব্ল্যাকহোলের খুব কাছে চলে আসে, তখন তার জন্য সময় কিছুটা ধীর গতিতে চলে। এই "সময় প্রসারণ" বা টাইম ডাইলেশন এক বিশেষ আপেক্ষিক প্রভাব, যার কারণে S62-এর এক ঘণ্টা পৃথিবীর হিসেবে প্রায় এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের মতো হয়।
S62 একবার ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘুরে আসে প্রায় ৯.৯ বছরে। কিন্তু এর পথটা গোল বা উপবৃত্তের মতো সহজ সরল নয়। বরং ঘুরতে ঘুরতে এর কক্ষপথ বদলে যায়, ঠিক যেন জ্যামিতির খাতায় আঁকা স্পাইরোগ্রাফের ডিজাইনের মতো। প্রতিবার ঘোরার পর এর কক্ষপথ প্রায় ১০ ডিগ্রির মতো বাঁক খায়। এই জটিল গতিপথ বোঝাতে নিউটনের ক্ল্যাসিকাল গতিবিদ্যার নিয়মগুলো যথেষ্ট নয়। এখানে উঠে আসে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার নিয়ম।
এরকম কক্ষপথের প্রিসেশন বা বাঁক পরিবর্তনের ঘটনা এর আগে বুধ গ্রহের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু S62-এর ঘটনাটি আরও বেশি অসাধারণ এবং চমকপ্রদ। এর আগে, ২০১৮ সালে বিজ্ঞানীরা S2 নামের আরেকটি ঘূর্ণায়মান নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। সেটিই প্রথমবার বাস্তবে দেখিয়েছিল কীভাবে ব্ল্যাকহোলের আশেপাশে নক্ষত্রের আলো লালচে হয়ে যায়। এই ঘটনাকে বলা হয়, গ্র্যাভিটেশনাল রেডশিফট।
এখন S62 সেই গবেষণার সুযোগকে আরও বড় করে তুলেছে। যখন এটা আবার ব্ল্যাকহোলের একদম পাশ দিয়ে যাবে, বিজ্ঞানীরা আশা করছেন তাঁরা আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবেন মহাকর্ষের প্রভাব কীভাবে কাজ করে, কীভাবে সময় ধীরে চলে, আর এই সবকিছু মিলিয়ে আমাদের গ্যালাক্সির মাঝখানে ঠিক কেমন পরিবেশ তৈরি হয়। এ যেন মহাবিশ্ব নিজেই আমাদের সামনে খুলে ধরেছে তার রহস্যের ঝাঁপি, যেখানে প্রকৃতির আশ্চর্য নিয়মগুলো চোখের সামনে ধরা পড়ছে।
তথ্যসূত্র: Florian Peibker এবং তাঁর সহকর্মীদের গবেষণা, “S62 on a 9.9 yr Orbit around SgrA*”, The Astrophysical Journal, 2020
Comments