রাতের আকাশে তাকিয়ে বেশ উজ্জ্বল একটি আলোর বিন্দুকে যদি এগিয়ে যেতে দেখেন, তাহলে বুঝে নিতে পারেন, সেটি কোনো তারা বা উল্কা নয়, সেটি হলো ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন, সংক্ষেপে আইএসএস। পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ওপরে, ঘণ্টায় ২৮,০০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে, প্রতিদিন পৃথিবীকে ১৬ বার প্রদক্ষিণ করা এই মহাকাশ স্টেশন মানুষের বিজ্ঞান কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া এক আশ্চর্য সাফল্য।
মহাশূন্যে অবস্থান করে মানুষের গবেষণা কেবল আইএসএস থেকেই শুরু হয়েছে, তা নয়। তার আগে এসেছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট—যার মধ্যে অন্যতম ছিল স্পেসল্যাব এবং মির। ১৯৮০-এর দশকে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং নাসার যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই স্পেসল্যাব। এটি আসলে ছিল একটা ল্যাবরেটরি মডিউল, যেটিকে যুক্ত করা হতো আমেরিকার স্পেস শাটলের সাথে। মহাকাশচারীরা কয়েকদিনের জন্য সেখানে থেকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন, তারপর ফিরে আসতেন পৃথিবীতে।
স্পেসল্যাব প্রকল্প বেশ কয়েকবার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয় যেমন জীববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, সৌর বিজ্ঞান, এমনকি মেডিক্যাল সায়েন্স সম্পর্কেও সেখানে গবেষণা হতো। তবে স্পেসল্যাব ছিল স্বল্পমেয়াদি। এর কার্যক্রম একেকবার একেক স্পেস শাটল মিশনের সঙ্গে যুক্ত থাকত। এটি কোন স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন ছিল না।
সোভিয়েত রাশিয়ার "মির" ছিল প্রথম স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন। এটি একসাথে মহাকাশে পাঠানো হয়নি; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অংশ (মডিউল) একে একে যুক্ত করা হয়েছিল। এতে যেমন বাড়ানো যেত স্টেশনের ক্ষমতা, তেমনই নতুন প্রযুক্তি যোগ করা যেত আগের কাঠামোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে। মির স্পেস স্টেশনের প্রথম মডিউল উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল প্রোটন রকেট ব্যবহার করে, আর পরবর্তী ছয়টি মডিউল ধাপে ধাপে যুক্ত হয় ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে। প্রতিটি মডিউলে ছিল বিভিন্ন গবেষণাগার, বাসস্থান, শক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা এবং ডকিং পোর্ট। মির ছিল এক চলন্ত মহাকাশ গবেষণাগার, যেখানে বিজ্ঞানীরা শূন্য মাধ্যাকর্ষণের পরিবেশে জৈব, পদার্থ, চিকিৎসা, এবং ভূবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে পারতেন। মজার বিষয় হলো, এখানেই প্রথম দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশবাস শুরু হয়। অনেক রুশ নভোচারী (কসমোনট) সেখানে ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সময় কাটিয়েছেন। রুশ মহাকাশচারী ভ্যালেরি পলিয়াকভ একটানা ৪৩৭ দিন মির-এ কাটিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন, যা আজও অক্ষুণ্ণ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে গবেষণার ক্ষেত্রে মিরের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল।
এই সীমাবদ্ধতাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই উঠে আসে আইএসএস-এর ভাবনা। একটি স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন, যেখানে মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করবে এবং নিয়মিতভাবে গবেষণা চালাবে। ১৯৯৮ সালে এই প্রকল্প শুরু হয় এবং ২০০০ সালের নভেম্বর থেকে সেখানে মানুষ টানা থাকতে শুরু করে। আইএসএস-এর সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, এটি পৃথিবীর বাইরে মানুষের আন্তর্জাতিক উপস্থিতির প্রথম সফল মঞ্চ।
এই প্রকল্পে অংশ নিয়েছে পাঁচটি মহাকাশ সংস্থা—NASA (যুক্তরাষ্ট্র), Roscosmos (রাশিয়া), ESA (ইউরোপ), JAXA (জাপান) এবং CSA (কানাডা)। একে একে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল এর বিভিন্ন মডিউল,যেগুলো ভাসমান অবস্থায় জুড়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল এক বৈজ্ঞানিক কমপ্লেক্স। আইএসএসের মূল মডিউলগুলো মহাকাশে পাঠাতে ব্যবহার করা হয়েছে আমেরিকার স্পেস শাটল এবং রাশিয়ার প্রোটন রকেট। এছাড়াও ছোটখাটো যন্ত্রাংশ ও মালামাল পাঠাতে ব্যবহার করা হয়েছে, রাশিয়ার সয়ূজ ও প্রগ্রেস মহাকাশযান, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার আরিয়ান ৫ রকেট এবং জাপানের এইচটিভি ট্রান্সফার ভেইকেল। আইএসএসকে মহাকাশে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে সময় লেগেছে প্রায় ১৩ বছর।
পুরো স্টেশনটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০৯ মিটার আর চওড়া প্রায় ৭৩ মিটার। অর্থাৎ একটি ফুটবল খেলার মাঠের সমান এর আয়তন। আইএসএসে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য আটটি বিশাল সোলার প্যানেল রয়েছে। এসব প্যানেল থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হওয়ার ফলেই আইএসএসকে পৃথিবী থেকে এত উজ্জ্বল দেখা যায়। আইএসএসের ভেতরে যেসব অংশে মানুষ বসবাস করতে পারে, সেগুলো মিলিয়ে মোট 'হ্যাবিটেবল' জায়গা রয়েছে ছয় রুমের একটি বড় অ্যাপার্টমেন্টের সমান। এই জায়গাতেই নভোচারীরা ঘুমান, খাওয়া-দাওয়া করেন, গবেষণা চালান আর ব্যায়ামও করেন। আইএসএসকে বাইরে থেকে দেখতে বেশ জটিল মনে হলেও, ভেতরে কিন্তু পুরোদস্তুর একটি বসবাসযোগ্য বাড়ি। মহাশূন্যে ভাসমান এই স্টেশন বানাতে খরচ হয়েছে আকাশছোঁয়া—প্রায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ব্যয়বহুল বৈজ্ঞানিক প্রকল্প। এছাড়া এর রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিবছর খরচ হয় তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার।
তবে এত খরচপাতি সত্ত্বেও এর ফলাফলও তুলনাহীন। আজ পর্যন্ত কুড়িটি দেশের ২৭০ জনেরও বেশি মহাকাশচারী, এখানে থেকে কাজ করেছেন। কেউ থেকেছেন এক সপ্তাহ, কেউ কয়েক মাস, কেউ বা প্রায় এক বছর। এখানে দীর্ঘদিন থাকার রেকর্ড গড়েছেন মার্কিন মহাকাশচারী স্কট কেলি এবং রাশিয়ার মিখাইল করনেনকো, যাঁরা একটানা ৩৪০ দিন আইএসএস-এ কাটিয়েছেন। এছাড়াও সম্প্রতি সুনিতা উইলিয়ামস কাটিয়ে এসেছেন ২৮৭ দিন। তবে এর আগেও তিনি দু'বার আইএসএসএ থেকেছেন।
আইএসএস-এ যাওয়া আসার পথও বদলেছে সময়ের সঙ্গে। এক সময় আইএসএস এ যাবার জন্য আমেরিকার স্পেস শাটল ও রাশিয়ার সয়ূজ মহাকাশযান ব্যবহার করা হতো। ২০১১ সালে স্পেস শাটল প্রোগ্রাম বন্ধ হবার পর রাশিয়ার সয়ূজ ছিল আইএসএস এ যাবার একমাত্র বাহন। কিন্তু এখন যুক্ত হয়েছে স্পেসএক্স-এর ক্রু ড্রাগন, যেটি অনেকটা স্বয়ংক্রিয় আর আধুনিক। এছাড়াও রয়েছে বোয়িং স্টার লাইনার যেটা একবার পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষ ছাড়াও এখানে নিয়মিত কার্গো পাঠানো হয় খাবার, পানি, যন্ত্রপাতি এবং বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম নিয়ে। এসব কিছুই পৃথিবী থেকে পরিচালিত হয় ঘড়ি ধরে। এখানে বলে রাখি, আইএসএস এ সব মিলিয়ে ছয়টি ডকিং স্টেশন আছে, অর্থাৎ এখানে একসাথে ছয়টি মহাকাশযানকে পার্ক করে রাখা সম্ভব।
স্পেস স্টেশনে জীবন কেমন? মজার আর কঠিন—দুটোই। মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় এখানে সবকিছু ভাসে, খাবারও তাই টিউব থেকে খেতে হয়, পানি গ্লাসে ঢালা যায় না। আর ঘুমাতে হলে নিজেকে বিছানার সাথে বেঁধে ঘুমোতে হয়। প্রতিদিন দু'ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হয়, না হলে শরীরের পেশি আর হাড় দুর্বল হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গবেষণার পরিধি বিশাল। ওষুধ থেকে শুরু করে, কোষের বৃদ্ধি, হাড়ের ক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তন, উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ, এমনকি মহাকাশে উদ্ভিদের জন্ম পর্যন্ত! এই গবেষণাগুলো পৃথিবীর চিকিৎসা, প্রযুক্তি আর আবহাওয়া বিজ্ঞানেও প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে যারা ভবিষ্যতে চাঁদ বা মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে চায়, তাদের জন্য আইএসএস একটা পরীক্ষাগার এবং মহড়া ঘর।
আইএসএস অবশ্য চিরকাল থাকবে না। বর্তমান দশকের শেষ দিকে, বিশেষ করে ২০৩০ সালের পর, নাসা এবং অন্য অংশীদাররা ধীরে ধীরে এই স্টেশন থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছে। তখন বেসরকারি সংস্থাগুলোর হাতে উঠবে মহাকাশ গবেষণার ব্যাটন। স্পেসএক্স, ব্লু অরিজিন, অ্যাক্সিয়ম স্পেস এবং আরো অনেক মহাকাশ সংস্থা এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসে যেটা লেখা থাকবে, সেটা হলো, মানুষের মহাশূন্য অভিযানে আইএসএস-ই ছিল সেই বিশাল পদক্ষেপ, যা মহাকাশে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল।
সুতরাং, যত নতুন কিছুই আসুক না কেন, আইএসএস থাকবে মহাকাশ বিজয়ের এক অনন্য প্রতীক হিসেবে। যেখানে মানুষ প্রথমবার একসঙ্গে, জাতির সীমানা ছাড়িয়ে, মহাশূন্যে একটি চমৎকার বাড়ি বানিয়েছিল। রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করা তারাগুলোর মাঝখানে একটি উজ্জ্বল আলোক বিন্দু যখন একটানা এগিয়ে চলে, তখন শুধু প্রযুক্তি নয়, মানুষের কল্পনা, প্রচেষ্টা আর ঐক্যের জয়গাথা ছুঁয়ে যায় আমাদের মনে।
Comments