মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক আলোকোজ্জ্বল অধ্যায় হলো অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী জুড়ে বিস্তৃত মুসলিম বিশ্বের সোনালী যুগ। সেই সময় মুসলিম বিশ্ব বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন ইউরোপে অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত থাকলেও বাগদাদের মতো নগরীগুলো ছিল জ্ঞান ও উদ্ভাবনের তীর্থকেন্দ্র।
এই সোনালী যুগের সূচনা হয়েছিল, বাগদাদের প্রসিদ্ধ বায়তুল হিকমাহ (জ্ঞানগৃহ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশিদ। এটি শুধু বিশাল এক গ্রন্থাগারই ছিল না, বরং ছিল নানা জাতি ও ধর্মের পণ্ডিতদের মিলনকেন্দ্র। সেখানে তাঁরা মুক্তচিন্তা ও জ্ঞান বিনিময় করতেন। গ্রিক, রোমান, পারসিক ও ভারতীয় পাণ্ডুলিপির অনুবাদ চলত দিনরাত। মুসলিম সভ্যতার এই মুক্তচিন্তা ও বিদ্যাচর্চার পরিবেশ থেকে জন্ম নেন অসংখ্য বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবক। যাঁদের গল্প মানবসভ্যতার অগ্রগতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এখানে সংক্ষেপে তাঁদের কয়েকজনের কাহিনী তুলে ধরা হলো:
বায়তুল হিকমাহ’র আলোকময় কক্ষে এক তরুণ গণিতবিদ গণনার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে মগ্ন। তিনি হলেন বীজগণিতের জনক মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোওয়ারিজমি। তিনি বীজগণিতকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রের রূপ দেন এবং অজানা মানকে চিহ্নিত করতে অক্ষর ব্যবহারের ধারণা চালু করেন। তাঁর রচিত “আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা” গ্রন্থটি বীজগণিতের প্রথম পাঠ্যবই। এই বইটি ইউরোপে অনূদিত হয়ে গণিতশাস্ত্রে বিপ্লব ঘটায়। গণিত শাস্ত্রে বহুল ব্যবহৃত, “অ্যালগরিদম” শব্দটিও এসেছে তাঁর নাম থেকে। তিনি দশমিক মান সংবলিত স্থানীয় মান পদ্ধতি ও শূন্যের ব্যবহার জনপ্রিয় করেন।
একই যুগে আরেক প্রতিভা ছিলেন ওমর খৈয়াম। মূলত একজন কবি হলেও, একাধারে তিনি ছিলেন একজন গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি জ্যামিতির সাহায্যে জটিল ঘনসমীকরণের সমাধান বের করেন। সুলতান মালিকশাহ’র আদেশে ওমর খৈয়াম একটি অত্যন্ত নির্ভুল সৌর ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। তাঁর উদ্ভাবিত ক্যালেন্ডারটি ৩৭৭০ বছরে মাত্র এক দিনের ভুল করে, যা গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের চেয়েও নিখুঁত।
নক্ষত্রলোকের রহস্য উদ্ঘাটনে অগ্রণী ছিলেন বহু মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। আল-বাত্তানি (হারুণ আল-বাত্তানি নামে পরিচিত) অত্যন্ত নিখুঁতভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান পরিমাপ করেন এবং জ্যোতির্বিদ্যায় হিসাব-নিকাশের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণসমূহ পরবর্তীকালে কোপার্নিকাসসহ ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত করে। নবম শতাব্দীর অপর জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল-ফারঘানি রচনা করেন একটি বিখ্যাত গ্রন্থ, যেটা “এলিমেন্টস অব অ্যাস্ট্রনমি” নামে অনূদিত হয়ে ইউরোপে বহু বছর জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি পৃথিবীর পরিধিও তুলনামূলকভাবে নির্ণয় করেন।
মুসলিম বিশ্বের সোনালী যুগের আরেক দিকপাল, আবু রাইহান আল-বিরুনী, অত্যন্ত মৌলিক চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী। মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতামতের জন্য তিনি ছিলেন বিখ্যাত। ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তিনি মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ভারতে তিনি প্রায় এক যুগ অবস্থান করেছিলেন এবং ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম হলো "কিতাবুল তারিকিল হিন্দ"। আল-বিরুনী ভূগোল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অসামান্য দক্ষ ছিলেন। তিনিও পৃথিবীর পরিধি মাপার প্রয়াস চালিয়েছিলেন এবং প্রকৃতি ও সভ্যতা নিয়ে বহুমুখী গবেষণা করেন।
এসময় মহাকাশের মানচিত্র তৈরিতে নারীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। দশম শতাব্দীর সিরিয়ায় মরিয়ম আল-লায়লা নামে এক নারী বিজ্ঞানী নিজের পিতার কাছ থেকে অ্যাস্ট্রোলাব তৈরির বিদ্যা শেখেন। তিনি জাহাজ পরিচালনা ও নক্ষত্রের অবস্থান নির্ধারণে অপরিহার্য যন্ত্র অ্যাস্ট্রোলাব নির্মাণে দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর এই আবিষ্কার মধ্যযুগে সামুদ্রিক দিকনির্ণয় ও সময়জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়। এজন্য তাঁর নাম হয়ে যায় মরিয়ম আল-আস্থ্রোলাবি।তাঁর তৈরি উন্নতমানের অ্যাস্ট্রোলাবগুলো সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করে নাবিক ও জ্যোতির্বিদদের পথপ্রদর্শক হয়েছিল।
সেই সোনালী যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞান ছিল যথেষ্ট উন্নত ও সুবিন্যস্ত। এ বিষয়ে অগ্রগামী ছিলেন আবু বকর মোহাম্মদ আল-রাজী। তিনি ছিলেন বাগদাদ হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক । চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান ব্যবহার শুরু করেন। রোগ নির্ণয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। রোগের লক্ষণ পর্যবেক্ষণে তাঁর জ্ঞান ছিল অসাধারণ। তিনিই সর্বপ্রথম ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিকেনপক্স ও হাম রোগকে পৃথক রোগ হিসেবে শনাক্ত করেন। শিশুদের চিকিৎসা ও প্রসূতিবিদ্যার অগ্রদূত হিসেবেও আল-রাজী খ্যাত। তাঁর লেখা চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের চিকিৎসাশাস্ত্রে গভীর প্রভাব ফেলে।
তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের আরেক মহান চিকিৎসক ছিলেন ইবনে সীনা। যিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশ্বকোষ "আল-কানুন ফিত-তিব" রচনা করেছিলেন, যা উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চিকিৎসা শাস্ত্রের রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই বিশ্বকোষ গ্রন্থে তিনি শরীরবিদ্যা, রোগের লক্ষণ এবং চিকিৎসাপদ্ধতি সুচারুভাবে বর্ণনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম মেনিনজাইটিস রোগের উপসর্গ লিপিবদ্ধ করেন এবং ঔষধবিদ্যা ও অ্যানাটমিতে মূল্যবান সংযোজন করেন। ইবনে সিনাকে বলা হতো "আল-শায়াখ আল-রাইস", মানে হলো জ্ঞানীদের শিরোমণি।
আল-আন্দালুসের চিকিৎসক আবু কাসিম আল-জাহরাভি শল্যচিকিৎসার জনক হিসেবে খ্যাত। তিনি ত্রিশ খণ্ডের বিশাল চিকিৎসা বিশ্বকোষ “কিতাব আল-তাসরিফ” রচনা করেন, যার শল্যবিদ্যার অংশটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শল্য চিকিৎসার মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আধুনিক যুগেও ব্যবহৃত বহু অস্ত্রোপচার সরঞ্জামের উদ্ভাবন হয়েছে তাঁরই হাত ধরে। যেমন অভ্যন্তরীণ সেলাইয়ের জন্য ক্যাটগাট সূতা, সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার ও ছানির অস্ত্রোপচারের উপযোগী যন্ত্রপাতি। তিনিই প্রথম বংশগত রক্তক্ষরণ (হিমোফিলিয়া) রোগটিকে শনাক্ত করেছিলেন এবং জরায়ুর বাইরে ভ্রূণস্থাপন (অ্যাক্টোপিক প্রেগন্যান্সি) এর বিবরণ দিয়েছিলেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরেক কিংবদন্তি ইবনে আল-নাফিস ১৩শ শতাব্দীতে শরীরতত্ত্বে যুগান্তকারী আবিষ্কার উপস্থাপন করেন। গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেন ধারণা করেছিলেন, হৃদযন্ত্রের ডান দিক থেকে বাম দিকে রক্ত রহস্যময় ছিদ্রপথে যায়। কিন্তু ইবনে আল-নাফিস প্রথম তা খন্ডন করে দেখান যে রক্ত ফুসফুসের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হয়ে বাম অংশে প্রবেশ করে। অর্থাৎ ফুসফুসীয় রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া তিনি আবিষ্কার করেন। ইউরোপে উইলিয়াম হার্ভে এই ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার প্রায় ৩০০ বছর আগেই ইবনে আল-নাফিস মানবদেহে রক্তপ্রবাহের এই তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন। দুঃখজনকভাবে, বহু শতাব্দী ধরে তাঁর এই অবদান বিশ্বের কাছে অজানাই রয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীতে তাঁর পাণ্ডুলিপি আবিষ্কারের পর এটি জানা যায়।
রসায়নবিদ্যায়ও মুসলিম বিজ্ঞানীরা পথিকৃৎ ছিলেন। জাবির ইবনে হাইয়ানকে “রসায়নের জনক” বলা হয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে আলকেমি (ধাতু পরিবর্তনের প্রাচীন ধারা) চর্চা করলেও জাবিরের পরীক্ষাধর্মিতা থেকেই আধুনিক রসায়নের ভিত্তি তৈরি হয়। তিনি বিভিন্ন পদার্থকে গরম করে, ডিস্টিলেশন প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধকরণ করে নতুন নতুন যৌগ উদ্ভাবন করেন। তিনিই প্রথম সালফিউরিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড পৃথকভাবে নিষ্কাশন করতে সক্ষম হন এবং স্বর্ণ ও পারদ পরিশোধনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞান পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত হয়েছিল। ইউরোপে মধ্যযুগে “জেবর” নামে পরিচিত এক রহস্যময় আলকেমির লেখায় আসলে জাবিরের রচনাবলীই অনূদিত হয়েছিল, যা ইউরোপীয় রসায়নবিদ্যার বিকাশে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
মুসলিম স্বর্ণযুগের বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অন্যান্য ক্ষেত্রেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আলোকবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত ইবন আল-হাইসাম বসরায় জন্ম নিলেও বিজ্ঞানচর্চার জন্য কায়রো ও কর্ডোবার জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে সময় কাটিয়েছেন। আল-হাইসামের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি “কিতাব আল-মানাজির” গ্রন্থ, যেখানে তিনি প্রথম ব্যাখ্যা করেন দৃষ্টিশক্তি কীভাবে কাজ করে। তিনি আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্র আবিষ্কার করেন এবং লেন্সের মাধ্যমে আলোর পথ পরিবর্তনের নীতি প্রবর্তন করেন। এই বইটি ইউরোপে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী অপটিক্স ও চক্ষুচিকিৎসায় মৌলিক পাঠ্য হিসেবে গণ্য হয়। আল-হাইসামই প্রথম ক্যামেরা অবস্কিউরার নীতি বর্ণনা করেন, যা পরবর্তীকালে ক্যামেরার উদ্ভাবনের পথ তৈরি করে।
নতুন উদ্ভাবন প্রসঙ্গে বাগদাদের তিন ভাই – বানু মুসা ব্রাদার্সের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। মুহাম্মদ, আহমদ ও হাসান এই তিন ভাই গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পৃথক দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তাদের রচিত “কিতাব আল-হিয়াল” গ্রন্থে একশটিরও বেশি যান্ত্রিক যন্ত্রের নকশা বর্ণনা করা হয়, যেগুলোর বেশিরভাগ ছিল তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন। নবম শতাব্দীতে রচিত এই গ্রন্থে এমন সব যন্ত্রের নকশা ছিল যেগুলো তাঁদের উদ্ভাবনী শক্তির ইঙ্গিত বহন করে। খনি শ্রমিকদের জন্য প্রাথমিক গ্যাস মাস্ক এবং জলকাদাময় স্থানে মাটি খোঁড়ার যন্ত্র ইত্যাদি নানারকম যন্ত্রের নকশা তাঁরা করেছিলেন। বানু মুসা ভ্রাতৃত্রয় একটি স্বয়ংক্রিয় বাঁশির খেলনা তৈরি করেছিলেন, যেটিকে বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামযোগ্য যান্ত্রিক যন্ত্র বলেও অভিহিত করা হয়।
এবার আরেক উদ্ভাবকের গল্প বলি। আব্বাস ইবনে ফিরনাস ছিলেন আন্দালুসের এক জ্ঞানতাপস যিনি প্রকৌশল ও কবিতাচর্চা করতেন। উমাইয়া খলিফার দরবারে রত্নগঠন নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি তিনি আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইতিহাসের বর্ণনা মতে, নবম শতাব্দীতে ইবনে ফিরনাস রেশম, কাঠ ও পাখির পালক দিয়ে দু’টি বড় ডানা তৈরি করে স্পেনের কর্ডোবার একটি উঁচু মিনার থেকে উড়াল দেন। তিনিই প্রথম মানুষ যিনি নিয়ন্ত্রিতভাবে উড়তে সক্ষম হন এবং জীবিত অবস্থায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান। ষাটোর্ধ্ব এ উদ্ভাবকের সেই গ্লাইডারে ভর করে আকাশে ওড়ার বিজ্ঞানমনস্কতা পরবর্তী যুগের বিমান আবিষ্কারে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
দ্বাদশ শতাব্দীতে উদ্ভাবনী প্রকৌশলে বিপ্লব আনেন ইসমাইল আল-জাজারি। আনাতোলিয়ায় এই প্রতিভাবান প্রকৌশলী দ্বাদশ শতাব্দীতে দুর্ধর্ষ সব স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও জলঘড়ি তৈরি করেন। ১২০৬ সালে তিনি “কিতাব ফী মাআরিফাত আল-হিয়াল আল-হান্দাসিয়া” গ্রন্থে প্রায় পঞ্চাশটি প্রোটোটাইপ যন্ত্রের নকশা ও বর্ণনা দেন। আল-জাজারির চমকপ্রদ আবিষ্কার ছিল ক্র্যাঙ্কশ্যাফ্ট ও পানির চেইন-পাম্পের সমন্বয়ে দ্বিমুখী সাকশান পাম্প, যা আগের সব প্রযুক্তিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আধুনিক গাড়ির ইঞ্জিনে যে ক্র্যাঙ্ক ও পিস্টন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, তার পূর্বসূরি হিসেবে আল-জাজারির যন্ত্রকে ধরা হয়। তাঁর ডিজাইনকৃত “কাসল ক্লক” বা প্রাসাদ-ঘড়িটিকে বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামযোগ্য অ্যানালগ কম্পিউটার বলেও অনেকে অভিহিত করে থাকেন। আল-জাজারির অভিনব সব স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি পরবর্তীতে ইউরোপে রেনেসাঁ যুগের প্রকৌশলী ও উদ্ভাবকদেরও পথ দেখিয়েছে।
এভাবে প্রায় ছয় শতাব্দী ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির পতাকা উড়িয়ে মুসলিম সভ্যতা একসময় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। ১২৫৮ সালে মঙ্গোল বাহিনী বাগদাদ বিজয় করে এবং জ্ঞানের কেন্দ্র বায়তুল হিকমাহ ধ্বংস করে দেয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এ ঘটনাই মুসলিমদের সোনালি যুগের অবসানের সূচনা করে। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বিভাজন, বহিরাক্রমণ ও রক্ষণশীলতার উচ্চাভিলাষ জ্ঞানচর্চার ধারাকে শ্লথ করে দেয়। আন্দালুসের পতন (১৪৯২) এবং ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তির উত্থানে মুসলিম বিশ্বে স্বাধীন গবেষণা ও উদ্ভাবনের পরিসর আরও সীমিত হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, যে সভ্যতা একসময় বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগামী ছিল, তা ক্রমে পিছিয়ে পড়তে থাকে। বর্তমানে ৫৭টি ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশ মিলে বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় মাত্র ১.১৭% অবদান রাখে, যেখানে একটি মাত্র ইউরোপীয় দেশ স্পেন এর চেয়েও বেশি (১.৪৮%) গবেষণা প্রকাশনা করছে। এই পরিসংখ্যান মনে করিয়ে দেয়, বর্তমান যুগের মুসলিম বিশ্ব প্রাচীন সেই জ্ঞানতাপসদের উত্তরাধিকার ধরে রাখতে পারেনি।
কিন্তু সেই সোনালী যুগের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জ্ঞান ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলে, একটি সভ্যতা কত দ্রুত শীর্ষে পৌঁছতে পারে। সে যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল মুক্তচিন্তা, নানা সংস্কৃতির জ্ঞানকে আত্মস্থ করার উদারতা এবং নতুন ধারণার প্রতি কৌতূহল। বাগদাদের জ্ঞানীগুণীরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একত্রে গবেষণা করেছেন, বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ অনুবাদ করে জ্ঞান সকলের জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন। আজকের যুগে মুসলিম বিশ্বের নতুন প্রজন্ম যদি আবার সেই জ্ঞানপিপাসা ও উদার চেতনা নিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষায় মনোনিবেশ করে, তবে আবারও একটি নবজাগরণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে।
Comments