ওলবার্স প্যারাডক্স: রাতের আকাশ কালো কেন?

ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরিক উইলহেল্ম ওলবার্স এক অদ্ভুত প্রশ্ন তুলেছিলেন—রাতের আকাশ কালো কেন? সাধারণ দৃষ্টিতে উত্তরটা তো সহজ—রাতে সূর্য থাকে না, তাই আকাশ থাকে অন্ধকার। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সহজ উত্তরকে সহজভাবে মেনে নেন না। ওলবার্স বললেন, ঠিক আছে, রাতে সূর্য নেই মানলাম, কিন্তু আকাশে তো কোটি কোটি নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি নক্ষত্রই তো একেকটা সূর্যের মতো আলোর উৎস। তাহলে তাদের সম্মিলিত আলোর ঝলকানিতে পুরো রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে না কেন?

এই প্রশ্নটির নামই পরে হয়েছে “ওলবার্স প্যারাডক্স”। যদিও এই প্রশ্ন ওলবার্সের আগে কেপলার, হ্যালি এমনকি নিউটনের আমলেও উঠেছিল, কিন্তু একে সুসংবদ্ধভাবে জনপ্রিয় করেন ওলবার্স ১৮২৩ সালে। এরপর থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নানাভাবে এই প্যারাডক্সের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন।

শুরুতে অনেকেই ভেবেছিলেন, মহাকাশে বিপুল পরিমাণ ধূলিকণা রয়েছে, যা নক্ষত্রের আলোকে আটকে দিচ্ছে। কিন্তু এটি ধরে নিলে প্রশ্ন ওঠে, এই ধূলিকণাগুলোও তো আলোকশক্তি শোষণ করে উষ্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিকিরণ করতে শুরু করতো। তাহলে তো ধূলিকণাগুলোও একসময় আকাশকে উজ্জ্বল করে তুলত। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না।

ওলবার্স প্যারাডক্সের অন্য এক ব্যাখ্যা আসে "লোহিত সরণ" (redshift) তত্ত্ব থেকে। যেসব নক্ষত্র আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাদের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হয়ে দৃশ্যমান আলোর সীমা ছাড়িয়ে অবলোহিত বা ইনফ্রারেড অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। তাই সেসব আলো আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে—তাহলে নিকটবর্তী নক্ষত্রদের অতিবেগুনি বা UV আলো কি লোহিত সরণ হয়ে দৃশ্যমান আলোতে পরিণত হচ্ছে? এর উত্তরও পরিপূর্ণ নয়।

এই ধাঁধার আসল সমাধান আসে বিংশ শতাব্দীতে, যখন বিগ ব্যাং তত্ত্ব জনপ্রিয়তা পায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, মহাবিশ্ব যতই বিশাল হোক না কেন, এর একটি বয়স রয়েছে—প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যেই আলোর রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাতে পেরেছে, এর চেয়ে দূরের আলোর রশ্মি এখনো আমাদের চোখে পৌঁছায়নি। ফলে যেসব জায়গা থেকে এখনো আলো আসেনি, সেগুলো আমাদের কাছে অন্ধকার দেখায়।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা হলো, মহাবিশ্বের প্রতিটি নক্ষত্রেরই একটি জীবনকাল আছে। তারা অনন্তকাল ধরে আলো ছড়ায় না। জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে তারা নিভে যায়। তাই নির্দিষ্ট এক সময়ে একটি সীমিত সংখ্যক নক্ষত্র থেকেই আলো আসছে। এই সংখ্যাটি অসীম নয়, তাই তারা পুরো রাতের আকাশকে দিনের মতো আলোকিত করতে পারে না।

১৯৬৪ সালে দুইজন মার্কিন রেডিও প্রকৌশলী, আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন, তাঁদের রেডিও টেলিস্কোপে এক অদ্ভুত ঝিরঝির শব্দ পান, যার উৎস খুঁজতে গিয়ে তাঁরা আবিষ্কার করেন—এই শব্দ আসছে আদিম মহাবিশ্ব থেকে। এটি আসলে সেই প্রাচীন মহাবিস্ফোরণের তাপ বিকিরণেরই রূপান্তরিত রেশ, যা আজ মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে পরিণত হয়েছে। একে বলা হয়, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা CMB বিকিরণ। এই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ১.৯ মিলিমিটার—যা দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কয়েক হাজার গুণ দীর্ঘ। তাই খালি চোখে একে দেখা যায় না, কিন্তু এটি মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান। আগেকার এনালগ টেলিভিশনে চ্যানেল না থাকলে যে ঝিরঝিরে ছবি আর শিরশিরে শব্দ শোনা যেত, তার একটি অংশও ছিল এই আদিম বিকিরণের প্রতিধ্বনি। এই CMB বিকিরণই হলো বিগ ব্যাং তত্ত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণগুলোর একটি। আর সেটিই ওলবার্স প্যারাডক্সের এক আধুনিক ব্যাখ্যাও। রাতের আকাশ কালো ঠিকই, কিন্তু সেই অন্ধকারের আড়ালেই লুকিয়ে আছে আদিম মহাবিশ্বের গল্প, যেখান থেকে এখনো আসছে অদৃশ্য বিকিরণের প্রতিধ্বনি।

Comments