সীমানা ছাড়িয়ে



২০০৫ সালে নাসার তৎকালীন প্রশাসক মাইকেল গ্রিফিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নাসার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হচ্ছে মহাকাশে মানব বসতি গড়ে তোলা। তাঁর মতে, এটা না করা হলে ভবিষ্যতে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। আসলে মাইকেল গ্রিফিন বাড়িয়ে কিছু বলেননি। প্রফেসর স্টিফেন হকিংও একই ধরনের কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হাজার বছরের মধ্যেই পৃথিবী থেকে মানব জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই বিপদ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে অন্য কোনো বাসযোগ্য গ্রহে মানব বসতি গড়ে তোলা। আর তাই আগেভাগেই পদক্ষেপ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

তবে কাজটা যে মোটেই সহজ নয়, সেটা সবাই জানে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কেবল পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদেই মানুষ পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যান্য গ্রহে শুধু মনুষ্যবিহীন নভোযান পাঠানো হয়েছে, যেগুলো থেকে আমরা বহু তথ্য পেয়েছি। এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন, আমাদের সৌরজগতে চাঁদ ছাড়া একমাত্র মঙ্গল গ্রহেই মানুষের বসবাসের কিছুটা সম্ভাবনা আছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখন বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানো। ইতোমধ্যে মঙ্গলে পাঠানো হয়েছে একাধিক রোবটযান, যেগুলো অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছে। বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন, মঙ্গলে মানুষ পাঠানো সম্ভব—এটা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

চাঁদে পৌঁছাতে স্যাটার্ন ৫ রকেটে সময় লেগেছিল মাত্র তিন দিন। নাসার মতে, বর্তমান প্রযুক্তিতে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পৌঁছাতে সময় লাগবে ২৫০ থেকে ২৬০ দিন। তবে যদি চাঁদ থেকে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে নভোযান ছাড়া যায়, তাহলে তা ১৩০ দিনেই সম্ভব হতে পারে। এ কারণেই নাসা আগে চাঁদে একটি ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। তাদের ধারণা, ২০৩০ সালের মধ্যেই এই ঘাঁটি নির্মাণ সম্ভব হবে। সেজন্যই এখন আবার চাঁদে ফেরার তোড়জোড় চলছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই ঘাঁটি থেকেই মানুষ রকেট চড়ে পৌঁছে যাবে মঙ্গল গ্রহে।

অন্যদিকে, স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্কের পরিকল্পনা আরও উচ্চাভিলাষী। তিনি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চাঁদে ঘাঁটি তৈরি করতে এবং দশ বছরের মধ্যে মঙ্গলে পৌঁছাতে চান। তাঁর পরিকল্পনা সফল হলে আমরা হয়তো আমাদের জীবদ্দশাতেই মঙ্গলের মাটিতে মানুষের পদচারণা দেখতে পাবো। এটা হবে মানবজাতির মহাকাশ জয় অভিযানের এক বিশাল পদক্ষেপ। তবে এটিই শেষ নয়—এটা হবে শুরু মাত্র।

মঙ্গল বিজয়ের পর সেখানেই ধাপে ধাপে মানব বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা হবে। কাজটা যে সহজ নয়, সেটা বলাই বাহুল্য। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল খুবই পাতলা, অক্সিজেনও অতি অল্প। মানবদেহের জন্য অনুপযোগী। তাছাড়া এখনো মঙ্গলে তরল পানির সুনিশ্চিত অস্তিত্ব মেলেনি, যদিও ধারণা করা হয়—মঙ্গলের মেরু অঞ্চলে বরফের আকারে পানি জমে আছে। ভবিষ্যতে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা সম্ভব হতে পারে।

মঙ্গলে মানব বসতির জন্য প্রথমে তৈরি করতে হবে কিছু বায়োস্ফিয়ার—যার ভেতরে মানুষ বাস করবে, গাছপালা লাগাবে, আর সেখান থেকেই নিজের খাদ্য উৎপাদন করবে। মহাশূন্যে গাছপালা কিভাবে বাড়ে—এ নিয়ে এখন অনেক গবেষণা হচ্ছে, যার ফল ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এই গবেষণায় বর্তমান যুগের তরুণ কৃষি বিজ্ঞানীরা আগ্রহী হতে পারেন। অনেকে ধারণা করছেন, এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই মঙ্গলে মানব বসতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে বসবাসের উপযোগিতা নেই বললেই চলে। তবে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা এবং শনির উপগ্রহ টাইটানে কিছু সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা দেখছেন। তাই ভবিষ্যতে এই দুটি উপগ্রহ নিয়েও পরিকল্পনা হতে পারে। এমনকি আগামী ২০০ বছরের মধ্যে ইউরোপা বা টাইটানেও মানুষ পৌঁছে যেতে পারে।

তবে সৌরজগতই মানুষের শেষ গন্তব্য নয়। মহাবিশ্ব তো আরো বিশাল! আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য গ্রহ, তার বাইরে আরও অনেক গ্যালাক্সিতে রয়েছে লক্ষ কোটি গ্রহ। ইতোমধ্যে পৃথিবীর মতো সাইজের বহু গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন, আমাদের কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাইকে প্রদক্ষিণ করছে ‘প্রক্সিমা বি’ নামের একটি গ্রহ, যা পৃথিবী থেকে মাত্র ৪.৫ আলোকবর্ষ দূরে।

আলোর গতিতে গেলে সেখানে পৌঁছতে লাগবে সাড়ে চার বছর। কিন্তু এই গতি—প্রায় ৩ লক্ষ কিমি/সেকেন্ড—এর চেয়ে বেশি গতিতে কোনো বস্তু চলতে পারে না, এটাই আইনস্টাইনের তত্ত্ব। অথচ ৪৫ বছর আগে উৎক্ষেপিত ভয়েজার ২ নভোযানের গতি সেকেন্ডে মাত্র ১৮ কিমি। সেই গতিতে চললে প্রক্সিমা বিতে পৌঁছাতে ৭০ হাজার বছর লাগবে! তাই দূরত্বই হচ্ছে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।

তবু বিজ্ঞান থেমে নেই। ২০১৬ সালে বিলিয়নিয়ার ইউরি মিলনার “ব্রেকথ্রু স্টারশট” নামে এক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এতে ক্ষুদ্র ন্যানো নভোযান—“স্টারচিপস”—তৈরি করে অত্যন্ত শক্তিশালী লেজার রশ্মির মাধ্যমে সেগুলোকে প্রপেল করে পাঠানো হবে প্রক্সিমা বিতে। এসব স্টারচিপস আলোর গতির এক-পঞ্চমাংশে চলবে, ফলে ২০ বছরেই পৌঁছাতে পারবে। তারপর পাঠানো তথ্য পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগবে আরও সাড়ে চার বছর। সবমিলিয়ে, মাত্র ২৫ বছরে আমরা সেই গ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবো—যদি প্রকল্পটি সফল হয়।

শুনতে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো হলেও, এ নিয়ে এখন সত্যিই কাজ চলছে। ভবিষ্যতের মানুষ হবে জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আরো অনেক এগিয়ে। তখন তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই মহাকাশ জয় তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠবে। পৃথিবীর বন্ধন ছেড়ে মানুষ ছুটে যাবে দূরে, বহুদূরে—অজানার পথে। সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য কোনো খানে।


Comments