বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়া মানেই হলো বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি। অর্থাৎ নোবেলজয়ী মানুষটি বিজ্ঞানের জগতে এমন কিছু করেছেন, যা মানবসভ্যতাকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু যদি একই পরিবারের দুই প্রজন্ম, পিতা ও পুত্র—দুজনেই এই মহাসম্মান অর্জন করেন, তাহলে সেটা শুধু ব্যক্তিগত গর্ব নয়, বরং এক অনন্য পারিবারিক ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত।
এই ধরনের ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি, তবে ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সাতটি পিতা ও পুত্র জুটি আছেন, যারা আলাদা সময়ে, আলাদা গবেষণায় কিংবা কখনো একসাথেও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
সবচেয়ে পরিচিত জুটি হলেন জে. জে. থমসন ও তাঁর পুত্র জর্জ থমসন। পিতা ১৯০৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান ইলেকট্রনের আবিষ্কারের জন্য। আর পুত্র ১৯৩৭ সালে পান ইলেকট্রনের তরঙ্গ প্রকৃতি দেখিয়ে, সেই আবিষ্কারের পরবর্তী ধাপটুকু তুলে ধরেছিলেন। যেন বাবা দেখালেন “ইলেকট্রন আছে”, আর ছেলে বললেন “এই ইলেকট্রন শুধু কণা নয়, এটা একই সাথে তরঙ্গও বটে!”
এরপর আসি উইলিয়াম ব্র্যাগ ও তাঁর ছেলে লরেন্স ব্র্যাগ-এর কথায়। তাঁরা দুজন একসাথেই ১৯১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান। কারণ তাঁরা একসাথে মিলে আবিষ্কার করেছিলেন কীভাবে এক্স-রে ব্যবহার করে স্ফটিকের গঠন বোঝা যায়। পুত্র লরেন্স ব্র্যাগ মাত্র ২৫ বছর বয়সে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত তিনিই বিজ্ঞানে নোবেলজয়ী সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি।
নিলস বোর ও তাঁর ছেলে আকে বোর এই তালিকার আরেক উজ্জ্বল নাম। নিলস বোর ১৯২২ সালে কোয়ান্টাম তত্ত্বে অসামান্য অবদানের জন্য নোবেল পান। তাঁর কাজ থেকেই আধুনিক কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার ভিত্তি তৈরি হয়। তাঁর ছেলে আকে বোর ১৯৭৫ সালে পারমাণবিক নিউক্লিয়াস নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পান। পিতা দেখালেন পরমাণুর গঠন, পুত্র জানালেন ভিতরের জটিলতা।
ম্যান্নে সেয়েবান ও তাঁর ছেলে কাই সেয়েবান ছিলেন সুইডিশ পদার্থবিদ। পিতা এক্স-রে স্পেকট্রাম নিয়ে কাজ করে ১৯২৪ সালে নোবেল পান, আর ছেলে ১৯৮১ সালে ইলেকট্রন স্পেকট্রোমিটার উন্নয়নের জন্য এই পুরস্কারে ভূষিত হন।
এবার আসি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে। হ্যান্স ভন ইউলার-চেলপিন ও উলফ ভন ইউলার এই জুটির পিতা ১৯২৯ সালে রসায়নে নোবেল পান—এনজাইম ও ভিটামিন নিয়ে গবেষণার জন্য। আর তাঁর ছেলে ১৯৭০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পান—মস্তিষ্কে স্নায়ু সংকেত কিভাবে যায় তা নিয়ে গবেষণার জন্য।
আর্থার কর্নবার্গ ও রজার কর্নবার্গ হলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী পিতা-পুত্র। পিতা ডিএনএ তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে ১৯৫৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পান। আর পুত্র রজার ২০০৬ সালে রসায়নে নোবেল পান, কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেন কিভাবে ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরি হয়। এক কথায়, পিতা পুত্র দু'জনেই ছিলেন মলিকিউলার বায়োলজির কাণ্ডারি।
সবশেষে, একেবারে সাম্প্রতিক এক জুটি—স্যুনে বের্গস্ট্রম ও স্বান্তে প্যাবো। পিতা বের্গস্ট্রম ১৯৮২ সালে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামে এক জৈব যৌগ নিয়ে কাজ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পান। আর পুত্র প্যাবো ২০২২ সালে প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন রহস্য জানার পথ খুলে দেন এবং সেজন্য তিনি নোবেল পান চিকিৎসাবিজ্ঞানে।
পিতা ও পুত্রের এই সাতটি জুটি প্রমাণ করেছেন - যদি অনুকূল পরিবেশ, প্রেরণা, আর বিজ্ঞানপ্রেমী পরিবারিক ঐতিহ্য থাকে, তাহলে জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। কেউ হয়তো পিতার পেশার অনুকরণে এগিয়েছেন, কেউ আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে গিয়েও জয় করেছেন নোবেল। কিন্তু এদের সবার মাঝেই ছিল অদম্য কৌতূহল, কঠোর পরিশ্রম, আর নতুন কিছু জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
নোবেল পুরস্কার শুধু একটা মেডেল আর অর্থ পুরস্কার নয়। এটা সাধনার ও সম্মানের প্রতীক। আর পিতা-পুত্র দুজনেই সেটা অর্জন করলে তা হয় ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী গর্বের গল্প।
Comments