আয়নার জগত


আমরা প্রতিদিনই আয়নাতে নিজেদের মুখ দেখি। সেখানে সবকিছুই চেনা, কিন্তু সবকিছুই উল্টো। ডানটা বাম, আর বামটা ডান। আয়নার জগৎ আর আমাদের বাস্তব জগৎ একসাথে পাশাপাশি থাকে, একে অপরের প্রতিচ্ছবি হয়ে। 

তবে জানেন কি? বিজ্ঞানের দুনিয়ায় এমন এক রহস্য রয়েছে, যেটা বলছে – আমাদের এই মহাবিশ্বটা আসলে আয়নার প্রতিচ্ছবির মতো নয়। আয়নার মধ্যে যেমন এক নিখুঁত অনুরূপ জগৎ থাকার কথা, বাস্তবে তার সঙ্গে মিল নেই। আমাদের এই মহাবিশ্বের গঠন, আইন-কানুন এমনভাবে সাজানো যে সে তারই নিজের প্রতিচ্ছবিকেই অস্বীকার করে।

এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ একটা প্রাকৃতিক শক্তি, যেটাকে বলে উইক ফোর্স বা দুর্বল পারমাণবিক বল। এই শক্তি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় যেমন বিটা ক্ষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, আর তার এক বিশেষ গুণ হলো—এটা কেবল ‘লেফট-হ্যান্ডেড’ বা 'বাম-হাতি' কণাগুলোর উপর কাজ করে। কণার ঘূর্ণনের দিক যদি তার চলার দিকের বিপরীত হয়, তাহলে তাকে বলে বাম-হাতি কণা। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, এই উইক ফোর্স কিন্তু ‘রাইট-হ্যান্ডেড’ কণাগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না। ফলে আয়নায় প্রতিফলিত সেই "বাম-হাতি" কণারা, যেগুলো সেখানে "ডান-হাতি" হয়ে পড়ে, তারা এই শক্তির কাছে একেবারেই অচেনা হয়ে যায়।

এই ঘটনার সব থেকে চমকে দেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত হলো নিউট্রিনো নামের এক রহস্যময় কণা। মহাবিশ্বে দেখা গেছে, সব নিউট্রিনোই বাম-হাতি।  কোনো ডান-হাতি নিউট্রিনো সংস্করণ বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে পাননি। তাহলে আয়নার সামনে নিউট্রিনোর কি কোনো প্রতিফলনই নেই? নাকি এমন কোনো আয়নার জগৎ আছে, যেখানে ডান-হাতি নিউট্রিনো ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু আমাদের চোখে ধরা পড়ছে না?

এই রহস্যগুলো শুধুই কণা পদার্থবিদ্যার বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাবিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নগুলো। এই যে আমাদের চারপাশের বস্তুজগৎ, তার অস্তিত্বই বা এলো কোথা থেকে?

মহাবিশ্বের শুরুতে পদার্থ আর প্রতিপদার্থ সমান পরিমাণে তৈরি হয়েছিল, তারা একে অপরকে নিঃশেষ করে দিতে পারত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকল শুধুমাত্র পদার্থের জগৎ। বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, আয়নার জগতের এই অসমতা, এই অসম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবিই হয়তো সেই রহস্যের চাবিকাঠি। যদি প্রতিটি নিয়ম আয়নায়ও একই রকমভাবে কাজ করত, তাহলে হয়তো মহাবিশ্ব কোনোদিনই টিকত না। এই ছোট্ট ভিন্নতা, উইক ফোর্সের বাম-হাতি পক্ষপাতিত্ব, হয়তো এই বিশাল মহাবিশ্বের জন্মের পেছনের মূল সূত্র। 

সত্যি কথা বলতে কী, আয়নায় শুধু মুখ দেখা হয় না, আয়নায় লুকিয়ে থাকে এক উল্টোমুখো বাস্তবতা। আমরা যা দেখছি, তার বিপরীত এক জগৎ যেন কেবল চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। আর সেই আশ্চর্য আয়নার জগৎকে বোঝার চেষ্টাতে বিজ্ঞান আজও অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলছে।

Comments