মহাবিশ্বের হারিয়ে যাওয়া পদার্থ


মহাবিশ্বে যা কিছু দৃশ্যমান, যেমন নক্ষত্র, নীহারিকা, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধুমকেতু - এসব কিছুই তৈরি হয়েছে সাধারণ পদার্থ বা অর্ডিনারি ম্যাটার দিয়ে।  কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই সাধারণ পদার্থের একটা বড় অংশ এতদিন লা পাত্তা ছিল। এতটা পদার্থ কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা বিজ্ঞানীরা খুঁজেই পাচ্ছিলেন না। এদের বলা হতো, "মিসিং ব্যারিয়নিক ম্যাটার",  অর্থাৎ হারিয়ে যাওয়া পদার্থ। 

এই পদার্থ কোনো কাল্পনিক জিনিস নয়। হিসেব করলেই বোঝা যেত, মহাবিশ্বে এই মিসিং সাধারণ পদার্থ থাকার কথা। কিন্তু টেলিস্কোপে এই হারিয়ে যাওয়া পদার্থের কোন হদিস পাওয়া যেত না। কিন্তু এবার বিজ্ঞানীরা খুব কৌশলে সেই পদার্থের খোঁজ পেয়েছেন। এজন্য তাঁরা ব্যবহার করেছেন, ফাস্ট রেডিও বার্স্টস (FRB) নামের একধরনের মহাজাগতিক রেডিও সংকেত। এগুলো এমন এক ধরনের রেডিও সিগন্যাল, যেগুলো খুব দূর থেকে হঠাৎ করে আসে, আর মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ড (এক সেকেন্ডের হাজার ভাগ) স্থায়ী হয়। মনে করুন, বাজ পড়ার মতো হঠাৎ একটা শব্দ বা আলোর ঝলকানি যেমন হয়, ঠিক সেরকমই।

এই FRB গুলো যখন এক গ্যালাক্সি থেকে বের হয়ে মহাশূন্য পার হয়ে পৃথিবীর দিকে আসে, তখন তার পথের মাঝে যেসব গ্যাস বা মহাজাগতিক ধূলিকণা থাকে, তাদের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা পরিবর্তিত হয়। বিজ্ঞানীরা সেই পরিবর্তনের ধরন দেখেই হিসেব করতে পারেন, মাঝখানে কতটা পদার্থ ছিল। এইভাবেই তারা বুঝেছেন, হারিয়ে যাওয়া পদার্থগুলো গ্যালাক্সির বাইরে লুকিয়ে আছে। আসল কথা হলো, মহাশূন্য একেবারে শূন্য নয়। গ্যালাক্সির মাঝের ফাঁকা স্থানগুলোকে বলা হয়, ইন্টার গ্যালাক্টিক মিডিয়াম। এইসব জায়গায় খুব হালকা প্লাজমা (অর্থাৎ চার্জযুক্ত গ্যাস) ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এইসব গ্যাস এতটাই হালকা যে সাধারণ টেলিস্কোপে এগুলো ধরা পড়ে না। 

কিন্তু এখন FRB ব্যবহার করে সেই প্রায় অদৃশ্য পদার্থগুলোও ধরা যাচ্ছে। ক্যালটেকের একদল বিজ্ঞানীর  সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মহাবিশ্বে সাধারণ পদার্থের প্রায় ৭৬% আছে গ্যালাক্সির বাইরের সেই হালকা গ্যাসে, ১৫% আছে গ্যালাক্সির চারপাশে থাকা হ্যালো নামের আবরণে, আর মাত্র ৯% রয়েছে গ্যালাক্সির ভেতরে। 

এখন প্রশ্ন হতে পারে, এতোটা পদার্থ গ্যালাক্সির বাইরে গেল কীভাবে? বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এটা সম্ভব হয়েছে অনেক বড় বড় মহাজাগতিক বিস্ফোরণের কারণে। যেমন, কোনো বিশাল নক্ষত্রের বিস্ফোরিত হয়ে সুপারনোভা হয়ে ওঠা, অথবা কোন ব্ল্যাকহোলের বাইরে হঠাৎ করে জেট ছুঁড়ে দেয়া। এই ধরণের ভয়ংকর ঘটনা এতটাই শক্তিশালী যে গ্যালাক্সির গ্যাসকেও ছুঁড়ে ফেলে দেয় অনেক দূরে,‌ একেবারে গ্যালাক্সির বাইরের মহাশূন্যে।

এই আবিষ্কারের তাৎপর্য অনেক গভীর। আগে বিজ্ঞানীরা যখন পুরো মহাবিশ্বের হিসাব করতেন, তখন দেখতেন,  সাধারণ পদার্থের অর্ধেকই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পদার্থ হারিয়ে যায় নি, বরং আমরাই এতদিন দেখতে পাচ্ছিলাম না। এখন হারিয়ে যাওয়া পদার্থগুলো খুঁজে পাওয়া গেল। তার মানে হলো, বিজ্ঞানীরা এবার অনেকটা নিশ্চিন্তে হয়ে বলতে পারবেন, মহাবিশ্বে যতটা সাধারণ বস্তু থাকার কথা, তার সবটাই খুঁজে পাওয়া গেছে।

এখন বিজ্ঞানীদের সামনে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেটা হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার। যেটা একদমই দেখা যায় না। কিন্তু মহাবিশ্বের গঠনে অনেকটাই প্রভাব ফেলে। সাধারণ বস্তু যখন পুরোপুরি খুঁজে পাওয়া গেল, তখন ডার্ক ম্যাটারকে আরও ভালোভাবে খুঁজে পাওয়ার রাস্তাও খুলে গেল। 

সব মিলিয়ে বলা যায়, মহাবিশ্ব একটা বিশাল রহস্যের ভান্ডার। তার ভেতরের কিছু অজানা রহস্য এখন ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে। আর সেই খোলার চাবিটা এসেছে চোখে দেখা যায় না এমন রেডিও তরঙ্গ থেকে। ছোট্ট একটা রেডিও সিগন্যালই আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, মহাবিশ্বে আরও কত কিছু এখনও  জানার  বাকি।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স সাইন্স।

Comments