চিলির আন্দিজ পর্বতের এক উঁচু চূড়ায় চালু হয়েছে ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি। এটা একটি অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ, যার মাধ্যমে আমরা এখন মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণ নতুন চোখে দেখতে পাবো। এই টেলিস্কোপ সম্প্রতি তার প্রথম ছবি প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে ‘ত্রিফিড’ আর ‘লাগুন’ নামের দুটি নীহারিকা। পৃথিবী থেকে প্রায় ৯,০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই অঞ্চল তারাগঠনের কেন্দ্র, আর সেখানে গ্যাস আর ধূলিকণার ঘূর্ণিপাক এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সৃষ্টি করেছে।
ভেরা রুবিন টেলিস্কোপের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর বিশাল ডিজিটাল ক্যামেরা, যার রেজোলিউশন ৩২০০ মেগাপিক্সেল। ক্যামেরার লেন্সের ব্যাস সাড়ে পাঁচ ফিট! এটাই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা।
এই একটিমাত্র ক্যামেরা প্রতি রাতে ৩০ টেরাবাইট ডেটা সংগ্রহ করতে পারবে। এর বিশাল সেন্সর, শক্তিশালী লেন্স এবং উন্নত প্রযুক্তি মহাবিশ্ব সম্পর্কে এমন সব তথ্য দেবে, যা আজ পর্যন্ত কেবল কল্পনার মধ্যেই ছিল। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, এই ক্যামেরা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৬৮ কোটি ডলার (১.৬৮ বিলিয়ন ডলার), যা বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
এই ক্যামেরা প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি করে ছবি তুলবে এবং প্রতিরাতে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে কাজ করবে। টানা ১০ বছর ধরে এটি দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করবে এবং প্রতি তিনদিন অন্তর অন্তর পুরো আকাশের নতুন ছবি তুলবে। ফলে জানা যাবে, কোন মহাজাগতিক বস্তুগুলো বদলাচ্ছে, আর নতুন কী কী বস্তু তৈরি হচ্ছে, অথবা হারিয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, চালু হবার মাত্র ১০ ঘণ্টার মধ্যেই এই টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেছে ২,১০৪টি নতুন গ্রহাণু এবং পৃথিবীর কাছে থাকা সাতটি মহাজাগতিক বস্তু। এখানে বলে রাখি, পৃথিবীর অন্যান্য টেলিস্কোপ সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ২০,০০০ এর মতো বস্তু খুঁজে পায়। এমন দ্রুতগতিতে তথ্য সংগ্রহ করার কারণে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভেরা রুবিন টেলিস্কোপ আমাদের সৌরজগত, গ্যালাক্সি, ব্ল্যাকহোল এবং অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে অসংখ্য নতুন তথ্য দেবে। এই টেলিস্কোপটির অবস্থান চিলির এমন এক স্হানে, যেখানে বাতাস শুকনো, কোনো আলোকদূষণ নেই, আর আকাশও থাকে একদম অন্ধকার। এসবই নিখুঁত পর্যবেক্ষণের জন্য আদর্শ।
এখন আসি সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্যে। ভেরা রুবিন টেলিস্কোপ প্রতি রাতে গড়ে প্রায় এক কোটি নতুন ঘটনা বা মহাজাগতিক বস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম। এর মানে, এই টেলিস্কোপ প্রতি রাতে প্রায় এক কোটি আলাদা ‘অ্যালার্ট’ পাঠাবে, যেগুলো হলো নতুন কোনো মহাজাগতিক ঘটনা, যেমন কোনো তারার হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, কোনো নতুন গ্রহাণুর আবির্ভাব বা আচরণগত পরিবর্তন। বিজ্ঞানীরা এই অ্যালার্টগুলো বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করবেন মহাবিশ্বে কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। এটিই হবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের মহাকাশ পর্যবেক্ষণের তথ্যভাণ্ডার। এই টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা এমন সব দুর্বল আলোক রশ্মি বিশ্লেষণ করতে পারবেন, যেগুলো এসেছে কোটি কোটি বছর আগের মহাজাগতিক ঘটনা থেকে।
এমনকি বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, বহু আলোচিত সেই ‘নবম গ্রহ’ যদি সত্যিই আমাদের সৌরজগতের কোথাও থেকে থাকে, তাহলে ভেরা রুবিনই সেটিকে খুঁজে বের করতে পারবে।
এই প্রকল্পে জড়িত বিজ্ঞানীদের জন্য এটি এক যুগান্তকারী ও আবেগঘন মুহূর্ত। কেউ কেউ ২৫ বছর ধরে এই কাজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আবার এখানে বেশকিছু নবীন মহাকাশ বিজ্ঞানী আছেন, যাদের কেউ কেউ আবার এই টেলিস্কোপের পরিকল্পনা শুরু হওয়ার পর জন্মেছেন। এখন সবকিছু মিলিয়ে, এই এক অভিনব যন্ত্র মহাবিশ্বকে জানার ধারাটি পুরোপুরি বদলে দিতে চলেছে।
ভেরা রুবিন টেলিস্কোপ শুধু একটা ছবি তোলার যন্ত্র নয়। এটি আমাদের সামনে মহাবিশ্বের অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরবে। আর সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা হয়তো একদিন বলতে পারবেন, আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবীটা বিশাল এই মহাবিশ্বে মহাকালের ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।
ভেরা সি রুবিন অবজারভেটরির ওয়েবসাইটে গেলে এ সম্পর্কে আরো তথ্য ও ছবি পাওয়া যাবে
https://rubinobservatory.org/
তথ্যসূত্র: বিবিসি সায়েন্স।
Comments