আমরা যখন স্কুলে ভেন ডায়াগ্রাম শিখেছি, তখন দেখেছি দুটি বা তিনটি বৃত্ত একে অপরের সঙ্গে কীভাবে আংশিকভাবে ওভারল্যাপ করে। বৃত্তগুলো আলাদা আলাদা স্বত্ত্বা হলেও, কোথাও গিয়ে একে অপরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এই সহজ ধারণাটাই যদি মহাবিশ্বের বাস্তবতায় প্রয়োগ করি, তাহলে ব্যাপারটা কি রকম হবে?
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের বাইরেও কি আরো অনেক মহাবিশ্ব রয়েছে? আর কোনোভাবে সেগুলো যদি আমাদের চেনা মহাবিশ্বের সাথে ওভারল্যাপ করে ফেলে? এই কল্পনাটাই এখন আর কেবল কল্পনা নয়। এটা আজকের আধুনিক কসমোলজির অন্যতম আলোচিত তত্ত্ব। অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, বিগ ব্যাংয়ের ফলে অসংখ্য "বাবল ইউনিভার্স" তৈরি হয়েছে এক বিশালতর বাস্তবতার ভেতর, যাকে বলে মাল্টিভার্স। বাংলায় একে "অনন্ত মহাবিশ্ব" বলা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন, এই বাবল ইউনিভার্স গুলো কখনো কখনো একে অপরকে ছুঁতে পারে, আবার কখনো ওভারল্যাপও করতে পারে, ঠিক যেভাবে ভেন ডায়াগ্রামের বৃত্তগুলো পরস্পরকে ছেদ করে।
মহাবিশ্ব এমনভাবে ওভারল্যাপ করলে কী হতে পারে? হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের কাঠামোই কিছুটা বদলে যাবে। হতে পারে কিছু কিছু "অস্বাভাবিক" জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা ঘটবে, যার ব্যাখ্যা আমাদের চেনা মহাবিশ্বের গাঠনিক নিয়ম দিয়ে সম্ভব নয়।
যেমন ধরুন, আজকাল আমরা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে দেখতে পাচ্ছি আদিম মহাবিশ্বের কাছাকাছি অবস্হাকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে পরিণত, পরিপূর্ণ সব গ্যালাক্সিকে! এত সুদূর অতীতে পূর্ণাঙ্গ সব গ্যালাক্সি কিভাবে তৈরি হলো? ব্যাপারটা কি বিস্ময়কর নয়? আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, পূর্ণাঙ্গ গ্যালাক্সির জন্ম হতে কোটি কোটি বছর লাগার কথা। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে, বিগ ব্যাংয়ের মাত্র কয়েক শো মিলিয়ন বছরেই পরিপূর্ণ গ্যালাক্সি তৈরি হয়ে গেছে। যেন কোনো ফাস্ট-ফরোয়ার্ড বোতাম টিপে দেওয়া হয়েছে। কে টিপলো এই বোতাম?
এর পাশাপাশি রয়েছে আরেকটি জটিল ধাঁধা, যার নাম, "হাবল টেনশন"। এখানে বলে রাখি, হাবল ধ্রুবক বা হাবল কনস্ট্যান্ট, এমন একটি সংখ্যা, যা দিয়ে মহাবিশ্ব ঠিক কতটা দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, সেটা জানা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই সংখ্যাটা সঠিকভাবে নিরূপণ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। কারণ হলো, হাবল ধ্রুবককে দুইভাবে মাপলে দুটি ভিন্ন সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।
প্রথম পদ্ধতিতে, বিজ্ঞানীরা ফিরে তাকাচ্ছেন সুদূর অতীতের দিকে। প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগের মহাবিশ্বের শিশুকালীন সময়ের দিকে। এই সময়ের তথ্য পাওয়া যায় এক ধরনের অতিপ্রাচীন বিকিরনের মাধ্যমে, যাকে বলে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন, সংক্ষেপে সিএমবি। এই বিকিরণ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখছেন, হাবল ধ্রুবকের মান দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড প্রতি মেগা-পারসেক।
অন্যদিকে, আধুনিক মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার পরিমাপ করতে বিজ্ঞানীরা নির্ভর করছেন সেফেইড ভেরিয়েবল তারকা ও সুপারনোভা পর্যবেক্ষণের উপর। এগুলোর উজ্জ্বলতা ও দূরত্বের মধ্যে নিখুঁত সম্পর্ক থাকায়, এগুলোকে বলা হয় 'কসমিক মাইলমার্কার'। এদের সাহায্যে মহাবিশ্বের বর্তমান বিস্তারের হার নির্ধারণ করা হলে দেখা যায়, হাবল ধ্রুবকের মান দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড প্রতি মেগা-পারসেক।
এখানেই আসল রহস্য। দুটি পদ্ধতি যদি সঠিক হয়, তাহলে সংখ্যাগুলি কেন মিলছে না? আর এই অমিল তো ছোটখাটো পার্থক্য নয়। প্রায় ৯% পার্থক্য! এর মানে দাঁড়ায়, মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে আমাদের ধারণা সঠিক নয়, নয়তো কসমোলজির সৃষ্টিতত্ত্বে কোথাও বড় ধরণের গরমিল রয়ে গেছে।
বিজ্ঞানীরা এনিয়ে মাথা চুলকাচ্ছেন। এ কেমন ব্যাপার! এই অসামঞ্জস্যের ব্যাখ্যা দিতে কেউ বলছেন, হয়তো কোনো অজানা কণিকা বা শক্তি কাজ করছে। কেউ বলছেন, বিগ ব্যাং মডেলই হয়তো অসম্পূর্ণ।
কিন্তু কেউ কেউ আবার সাহস করে বলছেন, হয়তো আমাদের এই মহাবিশ্বের ওপরে অন্য কোনো মহাবিশ্বের ছায়া পড়েছে। হয়তো অন্য মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের চেনা মহাবিশ্বের কোনো "ওভারল্যাপ" রয়েছে। কোনো এক সময়ে, বা কোনো এক মহাকর্ষীয় প্রভাবে হয়তো আমরা এখনও সেই ছায়ার ভেতরেই রয়েছি। এসবই শুনতে অবিশ্বাস্য লাগে। ঠিক যেমন বিগ ব্যাং থিওরিকে একদিন মনে করা হয়েছিল, হাস্যকর এক তত্ত্ব। অথচ সেই তত্ত্বই বর্তমানের কসমোলজির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে।
মাল্টিভার্স তত্ত্ব, মহাবিশ্বের ওভারল্যাপ, ফাস্ট-ফরোয়ার্ড গ্যালাক্সি—এসব হয়তো আজকের দিনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। কিন্তু এমনও হতে পারে, এগুলো আগামী দিনের বিজ্ঞানের বাস্তবতা।
একথা অনস্বীকার্য, বিশাল এই মহাবিশ্ব আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক অনেক বড়। হয়তো আমাদের চেনা মহাবিশ্বের বাইরেও অজানা অনেক মহাবিশ্ব রয়েছে। ভেন ডায়াগ্রামের মত করে সেই অচেনা মহাবিশ্বের কিছুটা ছায়া হয়তো পড়েছে আমাদের চেনা মহাবিশ্বের ভেতরে। সেটাই হয়তো মূর্ত হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের চেনা মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণযোগ্য নানান অসামঞ্জস্যের ভেতরে।
Comments