আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মাঝখানে রয়েছে দানবাকৃতির বিশাল একটি ব্ল্যাকহোল। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্যাজিটারিয়াস এ-স্টার (Sagittarius A*)। এই ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪৫ লক্ষ গুণ বেশি। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৬ হাজার আলোকবর্ষ। সুপারম্যাসিভ এই ব্ল্যাকহোলটি আবিষ্কার করার জন্য দু'জন বিজ্ঞানীকে ২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের নাম, এন্ড্রিয়া গেজ এবং রেইনহার্ড গেনজেল। আমরা জানি, ব্ল্যাকহোল হলো এমন এক আশ্চর্য মহাজাগতিক বস্তু, যার প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে আলোক রশ্মি পর্যন্ত সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে না।
বিজ্ঞানীরা এবার আবিষ্কার করেছেন, আমাদের গ্যালাক্সির দানবাকার ব্ল্যাকহোলটি স্থির হয়ে বসে নেই। এটি প্রবল বেগে ঘুরছে।
১৯৬৩ সালে রয় কার নামে নিউজিল্যান্ডের একজন গণিতজ্ঞ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণের সমাধান করে তাত্ত্বিকভাবে প্রথম দেখিয়েছিলেন, ঘূর্ণায়মান ব্ল্যাকহোল তার আশেপাশের স্থান-কালকে (space-time) নিজের সাথে টেনে নিয়ে ঘোরায়। এর ফলে ব্ল্যাকহোলের চারপাশে একটি বিশেষ এলাকা তৈরি হয় যাকে বলে, এরগোস্ফিয়ার। এই এলাকায় মহাকাশ পর্যন্ত ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে একসাথে ঘুরতে থাকে। এই এরগোস্ফিয়ার যেন এক মহাকাশীয় ঘূর্ণিঝড়, যেখানে কিছুই আর স্থির থাকতে পারে না। মহাশূন্য নিজেই সেখানে ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে ঘুরতে থাকে, বাধ্য হয়ে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে, ফ্রেইম ড্র্যাগিং ( Frame dragging)
এই ঘূর্ণন কেবল এক বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই এরগোস্ফিয়ার থেকেই শক্তি বের করা সম্ভব হতে পারে। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ রজার পেনরোজ বলেছিলেন, যদি কেউ এই এলাকায় কোনো বস্তু ফেলে, সেটি ভাগ হয়ে একটি অংশ ব্ল্যাকহোলের ভেতরে চলে যায়, আর আরেকটি অংশ অনেক বেশি শক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।
পেনরোজের এই বিস্ময়কর ধারণা থেকে বোঝা যায়, ব্ল্যাকহোল শুধু গ্রাস করে না, শক্তি ফিরিয়েও দিতে পারে। যেন ধ্বংসের মাঝেও রয়েছে এক সম্ভাবনার জন্ম।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা স্যাজিটারিয়াস এ-স্টার ব্ল্যাকহোলটি প্রায় আলোর গতিতে ঘুরছে। যেটা বস্তুর গতির সর্বোচ্চ সীমার প্রায় কাছাকাছি। অর্থাৎ আপেক্ষিকতার নিয়মে যতটা দ্রুত সম্ভব, এটি ততটাই জোরে ঘুরছে।
এর ফলে, স্যাজিটারিয়াস এ-স্টারের চারপাশে তৈরি হয়েছে এক দানবীয় ঘূর্ণি। এই তথ্য পাওয়া গেছে দূর মহাকাশ থেকে ভেসে আসা এক্সরে এবং রেডিও তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে।
এছাড়াও, পৃথিবীতে বসানো বিশাল ডিটেক্টর যেমন LIGO এবং VIRGO আগেই দেখিয়েছে যে দুটো ব্ল্যাকহোল একে অপরের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি করতে পারে। সব মিলিয়ে, ব্ল্যাকহোল এখন আর শুধুমাত্র কৌতুহলের বস্তু নয়। এটি মহাবিশ্বকে বুঝতে, ভবিষ্যতের সাম্ভাব্য শক্তির উৎস খুঁজতে এবং স্থান-কালের কাঠামো সম্পর্কে আরও জানার একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। ব্ল্যাকহোল নিয়ে বর্তমানের নিত্যনতুন গবেষণা ও আবিষ্কার আমাদের জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করে চলেছে।
তথ্যসূত্র: সায়েন্স এলার্ট।
Comments