সাধারণত সমসাময়িক কালের যুগান্তকারী কোনও আবিষ্কারের জন্যই বিজ্ঞানের তিনটি শাখায় প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে, ফিজিওলজি বা মেডিসিন ক্যাটাগরিতে নোবেল পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল এমন একজন বিজ্ঞানীকে, যাঁর অবদানের কথা সেসময় অনেকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। এই বিস্মৃতপ্রায় বিজ্ঞানীর নাম, ডক্টর বারবারা ম্যাকক্লিনটক।
যে আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেটি তিনি করেছিলেন প্রায় চার দশক আগে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই সময় তাঁর কাজটি সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি, বরং সমালোচিত হয়েছিল। আর একজন নারী বিজ্ঞানী হওয়ার কারণে প্রথাবিরোধী গবেষণাটি পুরুষপ্রধান বৈজ্ঞানিক সমাজ সহজভাবে গ্রহণ করেনি।
বারবারার জন্ম ১৯০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। ছোটবেলা থেকেই বারবারার বিজ্ঞান নিয়ে প্রবল কৌতূহল ছিল। কিন্তু সে সময় মেয়েদের জন্য বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করাটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। বিশেষ করে তাঁর মা এক্ষেত্রে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু বাবার উৎসাহে তিনি ভর্তি হন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে এবং বেছে নেন জেনেটিক্সের মতো একটি কঠিন বিষয়। ১৯২৭ সালে পিএইচডি শেষ করেন। তখন থেকেই তাঁর আগ্রহ জন্মায় সাইটোজেনেটিক্সে।
ক্রোমোজোমের গঠন, কার্যপ্রণালী আর আচরণ নিয়ে কাজ করতেন তিনি। দুর্দান্ত মাইক্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা ছিল তাঁর। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বসে মাইক্রোস্কোপের নিচে তিনি এমন সব সূক্ষ্ম পরিবর্তন খুঁজে পেতেন যা অনেকের চোখে পড়ত না। তিনি ভুট্টার ক্রোমোজোম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নতুন কিছু কৌশল উদ্ভাবন করেন এবং জেনেটিক্সে গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য যুক্ত করেন।
তাঁর গবেষণায় প্রথমবারের মতো ভুট্টার দশটি ক্রোমোজোমের জেনেটিক ম্যাপ তৈরি হয়। তিনি সাইটোজেনেটিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মেয়োসিসের সময় ক্রোমোজোমের মধ্যে 'ক্রসিং ওভার' এর স্পষ্ট প্রমাণ দেখাতে সক্ষম হন। তাছাড়া, সেন্ট্রোমিয়ার ও টেলোমিয়ারের গঠন ও ভূমিকা নিয়েও তিনি ব্যাখ্যা দেন, যেটা জিনের স্থায়িত্ব ও বংশগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চল্লিশের দশকে নিউইয়র্কের কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময়, ভুট্টার কিছু ক্রোমোজোম পর্যবেক্ষণ করে তাঁর মনে হলো, সব জিন সবসময় একই জায়গায় থাকছে না। যেন কিছু জিন মাঝে মাঝে তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে। এই সন্দেহ যাচাই করতে তিনি হাজার হাজার ভুট্টার সংকরায়ন করে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা চালান। অবশেষে তিনি নিশ্চিত হন, ক্রোমোজোমের ভেতরে কিছু জিন তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে। এর ফলে ভুট্টার দানার রঙও বদলাচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি ধারণা করেন, জিনের বহিঃপ্রকাশ, অর্থাৎ জিন যেভাবে নিজের কার্যকারিতা প্রকাশ করে, সেটা তার অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফল বিজ্ঞানজগতে প্রকাশ করেন। কিন্তু সেসময় তাঁর এই ‘জাম্পিং জিন’ তত্ত্ব বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই মেনে নিতে চাননি। প্রচলিত ধারণা ছিল, ক্রোমোজোমের ভেতরে জিনগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় স্থিরভাবে থাকে। তাই কেউই বারবারার কথায় খুব একটা কান দেননি। এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী এমনও মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে কিছু দুর্বলতা আছে, যার ফলে গবেষণার ফলাফল বিভ্রান্তিকর হতে পারে। এতসব সমালোচনায় তিনি বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হন এবং একপর্যায়ে তিনি এ বিষয়ে আর নতুন কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের চাকা ঘুরে যায়। চল্লিশের দশকে ডিএনএ-র গঠন ও কার্যপ্রণালী নিয়ে বিজ্ঞানীদের খুব একটা ধারণা ছিল না। কিন্তু ৫০ ও ৬০-এর দশকের পর মলিকিউলার বায়োলজির বিস্ময়কর উন্নতির ফলে জিন ও ডিএনএ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। আর তখন বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন 'ট্রান্সপোজেবল এলিমেন্ট' বা 'ট্রান্সপোসন'। এগুলো আসলে ছিল বারবারার সেই ‘জাম্পিং জিন’ এর আধুনিক নামান্তর। এই ট্রান্সপোসনরা ডিএনএ-র মধ্যে নিজের অবস্থান বদলে বিভিন্ন জিনের কার্যকলাপে প্রভাব ফেলে। শুধু ভুট্টা নয়, ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদ, প্রাণী এমনকি ভাইরাসেও ট্রান্সপোসন পাওয়া গেছে। জিন রেগুলেশনের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সত্তরের দশকের শেষ দিকে এসে বারবারার ‘জাম্পিং জিন’ তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মহলে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৮৩ সালে তিনি এককভাবে ফিজিওলজি বা মেডিসিন ক্যাটাগরিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বয়স তখন তাঁর আশি ছুঁই ছুঁই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পুরানো কাজের এই স্বীকৃতি ছিল তাঁর জন্য বড়ো প্রাপ্তি।
আজীবন অবিবাহিত এই বিজ্ঞানীর জীবনের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী ছিল তাঁর গবেষণাগার। বিজ্ঞানই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি, তাঁর আত্মীয়স্বজন। নোবেল কমিটি তাদের সম্মাননাপত্রে বারবারার এই মৌলিক কাজকে জেনেটিক্সের জনক মেন্ডেলের কাজের সাথে তুলনা করেছিলেন। এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কী হতে পারে?
© তানভীর হোসেন
(লেখাটি “শতাব্দীর বিজ্ঞান” গ্রন্থ থেকে সামান্য পরিবর্তন করে নেওয়া হয়েছে)
Comments