এক্সোপ্ল্যানেট: নক্ষত্রের আলোয় লুকোনো গ্রহ

নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলোর আড়ালে, মহাবিশ্বের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ গ্রহ। যাদের আমরা বলি এক্সোপ্ল্যানেট। আমাদের সৌরজগতের বাইরে এসব গ্রহ কোনো না কোনো নক্ষত্রকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই অনুমান করে আসছিলেন, আমাদের সূর্যের মতো অন্যান্য নক্ষত্রেরও নিজস্ব গ্রহমন্ডলী থাকতে পারে। কিন্তু ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো সেই অনুমান সত্যি হয়ে ধরা দেয়। সুইস জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র ও দিদিয়ার কুয়েলোজ আবিষ্কার করেন ৫১ পেগাসি বি নামের এক্সোপ্ল্যানেটটি। এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের জন্য তাঁরা ২০১৯ সালে নোবেল পুরস্কারও পান।

তারপর থেকেই এক্সোপ্ল্যানেট গবেষণায় এক বিপ্লব ঘটে। আজ পর্যন্ত ছয় হাজারেরও বেশি এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করা হয়েছে।
এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীরা প্রধানত দুটো পদ্ধতি ব্যবহার করেন। একটি হলো ট্রানজিট মেথড, যেখানে গ্রহটি যখন তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যায়, তখন নক্ষত্রের আলো অল্প সময়ের জন্য ম্লান হয়ে যায়। এই আলো কমার ধরন বিশ্লেষণ করেই গ্রহের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। আরেকটি হলো রেডিয়াল ভেলোসিটি মেথড, যেখানে গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ টানে নক্ষত্র সামান্য দুলে ওঠে। এর ফলে নক্ষত্রের আলোতে যে হালকা রেডশিফট ও ব্লুশিফট হয়, সেটি বিশ্লেষণ করেই গ্রহের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।

বিজ্ঞানীরা এখন ধারণা করছেন, মহাকাশে দৃশ্যমান অধিকাংশ নক্ষত্রেরই নিজস্ব গ্রহমন্ডলী রয়েছে। এসব গ্রহের বৈচিত্র্য সত্যিই বিস্ময়কর। এর কোনটি পাথুরে গ্রহ,  কোনটি গ্যাসীয় দৈত্য, আবার  এমন আজব জগত রয়েছে যেখানে কাঁচের বৃষ্টি ঝরে আর ঘূর্ণিঝড়ের গতি ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়।

এসব বিস্ময়কর এক্সোপ্ল্যানেটের একটি উদাহরণ হলো WASP-121b, এক গ্যাসীয় দৈত্য গ্রহ যা তার নক্ষত্রের এতটাই কাছে ঘোরে যে তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যায় ২৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এজন্য এই গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে ধাতব বাষ্প পর্যন্ত পাওয়া যায়। আবার HD 189733b নামের আরেকটি গ্রহ গাঢ় নীল রঙের হলেও তার সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিভীষিকাময় বাস্তবতা। যেখানে প্রবল ঝড়ে আয়রনের কণা বৃষ্টির মতো ঝরে।

এর পাশাপাশি TRAPPIST-1 নামের একটি লাল বামন নক্ষত্রকে ঘিরে সাতটি পাথুরে গ্রহের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে তিনটি পৃথিবীর মতো হ্যাবিটেবল জোনে অবস্থান করছে। এই গ্রহগুলোতে পানির অস্তিত্ব থাকাও অসম্ভব নয়, আর তাই এখানে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে।

সবচেয়ে সিনেমাটিক এক গ্রহের নাম Kepler-16b। এটি দুটি সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এর ফলে সেখানে দুটি সূর্যাস্ত হয়, দুটি ছায়া পড়ে, যেন একেবারে “স্টার ওয়ারস”এর টাটুইন গ্রহের বাস্তব উদাহরণ। আরো আছে  55 Cancri e, যার কক্ষপথ এতটাই ছোট যে একটি বছর সেখানে হয় মাত্র ১৮ ঘণ্টায়, আর এই গ্রহটির অভ্যন্তরে থাকতে পারে হীরের পাহাড়!

আজকের দিনে বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র এসব এক্সোপ্ল্যানেটের অস্তিত্ব জানেন না, তারা এদের সরাসরি ছবিও তুলতে শুরু করেছেন। এই অগ্রগতির পেছনে আছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি। যেমন HR 8799 নামক একটি নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তিত চারটি গ্যাসীয় গ্রহের ছবি প্রথমবারের মতো সরাসরি তোলা হয়েছে। 

এসব ছবি তুলতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন করোনাগ্রাফ নামের এক বিশেষ যন্ত্র, যা নক্ষত্রের তীব্র আলোকে ব্লক করে তার আশেপাশের ম্লান গ্রহগুলোর আলোর ঝলক তুলে আনে। এরপর সেই আলোর স্পেকট্রা বিশ্লেষণ করে জানা যায়, এদের বায়ুমণ্ডলে কী কী উপাদান আছে। অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, এমনকি জলীয় বাষ্পও এসব বিশ্লেষণে ধরা পড়ে। 

এসব পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণের
প্রতিটি ধাপে বিজ্ঞানীরা একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন - মহাবিশ্বে আমরা কি একা? আসলে মহাবিশ্বের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চোখ মেলে আমরা কেবল রহস্য দেখছি না, জীবনের সম্ভাবনাও দেখছি। হয়তো কোনো এক দূর নক্ষত্রের আলোয় ঢেকে আছে এমন এক গ্রহ, যেখানে প্রাণ সৃষ্টির অঙ্কুর ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে।

এক্সোপ্ল্যানেট গবেষণা এখন আর কোন কল্পবিজ্ঞান নয়। এ এক জীবন্ত ও চলমান অনুসন্ধান, যার প্রতিটি আবিষ্কার মহাবিশ্বে আমাদের নিজস্ব অবস্থান সম্বন্ধে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। 

তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ।

Comments