আমাদের এই বুড়ো পৃথিবীটার বয়স প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি বছর। বিজ্ঞানীরা এই বয়স নির্ধারণ করেছেন প্রাচীন শিলার তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের হিসেব থেকে। এছাড়া, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, সৃষ্টির আদি যুগে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি ছিল আজকের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবী ধীরে ধীরে তার ঘূর্ণনের গতি হারিয়েছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এর প্রভাব ছিল বিশাল। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রায় ১.৪ হাজার কোটি বছর আগে একটি দিনের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ১৮ ঘণ্টা। যেখানে আজকের সময়ে এসে আমরা ২৪ ঘণ্টার একটি দিন পাচ্ছি।
পৃথিবীর এই ধীরগতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে চাঁদ। চাঁদের মহাকর্ষীয় বল পৃথিবীর ওপর টান সৃষ্টি করে। তার ফলে সাগরের জলে জোয়ারের ঢেউ ওঠে। জোয়ারের এই ঢেউ চাঁদের সরাসরি নিচে না থেকে, সামান্য কিছুটা এগিয়ে থাকে। কারণ পৃথিবী চাঁদের চেয়ে কিছুটা দ্রুত ঘুরছে। এই ঢেউকে টেনে রাখতে গিয়ে চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে তৈরি হয় টানাপোড়েন। এর ফলে সৃষ্টি হয়, টাইডাল ফ্রিকশন। এই ফ্রিকশন ধীরে ধীরে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে চাঁদও প্রতি বছর একটু করে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবেই কালের পরম্পরায় পৃথিবীর দিন বড় হয়েছে চাঁদের মৃদু আকর্ষণে।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পৃথিবীর এই ধীর গতি জীবনের বিকাশের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে। প্রায় আড়াই হাজার কোটি বছর আগের পৃথিবীতে, সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামের এক ধরনের নীল-সবুজ শৈবালের উদ্ভব হয়েছিল। এরা ফটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করত। কিন্তু যখন দিনের দৈর্ঘ্য ছিল ছোট, তখন এই শৈবাল পর্যাপ্ত সময় পেত না ফটোসিন্থেসিস চালানোর জন্য। ফলে বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন জমা হতে পারত না। পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর হওয়ার ফলে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়তে শুরু করে, আর এই অতিরিক্ত সময় শৈবালদের অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য বাড়তি সুযোগ এনে দেয়। এর ফলেই ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলেন, "গ্রেট অক্সিডেশন ইভেন্ট", এটা পৃথিবীতে জীবনের বিকাশের জন্য একটি বিশাল মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
আজও পৃথিবীর ঘূর্ণন ক্রমশ ধীর হচ্ছে। বর্তমান হিসেব অনুযায়ী, প্রতি শতাব্দীতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৮ মিলিসেকেন্ড করে বাড়ছে। যদিও এই পরিবর্তন আমাদের জীবদ্দশায় তেমন কিছু মনে হয় না, কিন্তু কোটি কোটি বছরের স্কেলে এই পরিবর্তন পৃথিবীর জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য এবং ভূতাত্ত্বিক ঘটনাগুলোর ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছে এবং ভবিষ্যতেও ফেলবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, পৃথিবীর ধীরে ঘুরে যাওয়া শুধু সময়ের হিসেবকেই বদলে দেয়নি, বরং জীবনের অস্তিত্বের জন্যও এক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। প্রকৃতির এই সামান্য পরিবর্তনই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
তথ্যসূত্র:
https://www.sciencealert.com/earths-rotation-is-slowing-down-and-it-could-explain-why-we-have-oxygen
Comments