নতুন এক পরমাণু বিপ্লবের পথে চীন?

বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকদিন ধরে গুঞ্জন চলছিল, চীন কি পারমাণবিক শক্তির নতুন এক যুগে ঢুকছে? সেই জল্পনা এবার আরও জোরালো হলো, যখন চীনের গোবি মরুভূমি থেকে পাওয়া গেল একটি ঐতিহাসিক সাফল্যের খবর। চীনা বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন, তাঁরা সফলভাবে একটি থোরিয়াম-চালিত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর চালু করেছেন। শুধু তাই নয়, রিঅ্যাক্টরটি চলমান অবস্থায় পুনরায় জ্বালানিও ভরেছেন, যেটা পৃথিবীতে এই প্রথম!

এই ঘটনা পারমাণবিক শক্তির ইতিহাসে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল। আমরা এতদিন পারমাণবিক চুল্লির ক্ষেত্রে ইউরেনিয়ামের নামই শুনে এসেছি। ইউরেনিয়াম বিপুল শক্তি তৈরি করলেও তার সঙ্গে রয়েছে বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ঝুঁকি। কিন্তু থোরিয়াম? এটা যেমন প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তেমনি নিরাপদ। থোরিয়াম দিয়ে বোমা বানানো প্রায় অসম্ভব, তাই যুদ্ধ ঝুঁকি একেবারেই কম। আর এখানেই আছে থোরিয়াম-চালিত রিঅ্যাক্টরের বিশাল ভবিষ্যৎ।

গোবি মরুভূমির এই ছোট্ট দুই-মেগাওয়াটের রিঅ্যাক্টরটি ‘মল্টেন সল্ট রিঅ্যাক্টর’ বা গলিত লবণ-চালিত রিঅ্যাক্টর নামে পরিচিত। এখানে জ্বালানি ও কুল্যান্ট দুটোই গলিত লবণের মতো তরল। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি সাধারণ‌ পানি-ভিত্তিক রিঅ্যাক্টরের চেয়ে অনেক নিরাপদ। এর চাপ কম, তাপমাত্রা বেশি সহ্য করতে পারে, আর দুর্ঘটনা ঘটলেও গলিত জ্বালানি নিজে নিজেই ঠান্ডা হয়ে যায়। ফলে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো বিস্ফোরণের আশঙ্কা নেই।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, এই রকম রিঅ্যাক্টরের ধারণা একেবারে নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকাই প্রথম এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। এমনকি পরিকল্পনা ছিল গোপন পরমাণু বোমার মতো 'স্টেলথ বোমা' বানানোর জন্য এই ধরনের রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করার! কিন্তু ১৯৬১ সালে মার্কিন কংগ্রেস ফান্ডিং বন্ধ করে দেয়। আর ইউরেনিয়ামের আধিপত্য শুরু হয়। সেই গবেষণার তথ্য আজও উন্মুক্ত, আর সেই সূত্র ধরেই চীন আবার নতুন করে থোরিয়াম যুগে ঢুকেছে।

এই প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী Xu Hongjie এক ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, "খরগোশ যখন অলস হয় বা ভুল করে, তখনই কচ্ছপ তার সুযোগটা নিয়ে নেয়।" চীন জানে, পৃথিবীর সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শক্তির চাহিদা মেটানো, কিন্তু সেটা করতে হবে নিরাপদে ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে। থোরিয়াম আর মল্টেন সল্ট রিঅ্যাক্টরের এই যুগান্তকারী মিশ্রণ হয়তো সেই পথই দেখাচ্ছে।

এটা নিছক একটা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়। এটা হতে পারে শক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির শুরু। যেখানে পারমাণবিক শক্তি মানেই শুধু যুদ্ধ আর বিপদের নাম হবে না, বরং হবে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও টেকসই শক্তির এক বিকল্প।

Comments