গাছের বার্তা

১৯০১ সালে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর উদ্ভাবিত এক অনন্য যন্ত্র দিয়ে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন, গাছও তাদের পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল। গাছ তাতে সাড়া দেয় এবং প্রতিক্রিয়া জানায়। তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রের নাম ছিল, ক্রেসকোগ্রাফ। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি গাছের মধ্যে সূক্ষ্মতম পরিবর্তনও রেকর্ড করতে পারতেন। পরীক্ষাগারে তিনি গাছের উপর বিদ্যুৎ, তাপ, গ্যাস কিংবা রাসায়নিক উদ্দীপক প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলেন, উদ্ভিদ সেই উদ্দীপনায় সাড়া দেয়। সেই প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে ধরা পড়তো তাঁর ক্রেসকোগ্রাফে। তখনকার দিনে অনেকে তাঁর এই গবেষণাকে সংশয়ভরে দেখলেও, আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞান এই কাজের অনেক দিকেই নতুন করে আলোকপাত করেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের অভ্যন্তরীণ সংকেত ব্যবস্থা নিয়ে এক চমকপ্রদ গবেষণা করেছেন।  এটা যেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কাজেরই আধুনিক সম্প্রসারণ। 

এই গবেষণায় দেখা গেছে, গাছের ভেতরে রয়েছে এক জটিল বার্তাবাহক ব্যবস্থা, যা মূলত কাজ করে ভাস্কুলার সিস্টেমে (জাইলেম ও ফ্লোয়েম) বিদ্যমান নেগেটিভ প্রেসার বা টেনশনের মাধ্যমে।
এই ভাস্কুলার সিস্টেম শুধু পানি ও পুষ্টি পরিবহণের কাজই করে না, এটি সংকেত পরিবহণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যখন গাছ কোনো ধরনের স্ট্রেসের মুখে পড়ে, যেমন জলস্বল্পতা, অতিরিক্ত গরম বা পোকামাকড়ের আক্রমণ, তখন জাইলেম টিস্যুতে পানির টান বা প্রেসারে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন পুরো গাছজুড়ে একটি সংকেতের ঢেউ তৈরি করে। একই সময়ে নির্গত হয় কিছু রাসায়নিক পদার্থ, যেমন জ্যাসমোনিক অ্যাসিড, যা গাছের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে। আক্রান্ত পাতার রাসায়নিক বার্তা পানির সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে পড়ে অন্য পাতায়, ডালপালায়, এমনকি শেকড় পর্যন্ত। তখন গাছের বাকি অংশগুলো সতর্ক হয়ে যায় এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করে। তবে প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রের মত এটা কোনো বৈদ্যুতিক সংকেত নয়। এটা একটি অভিনব মেকানিক্যাল বার্তাবাহক ব্যবস্থা, যেখানে পানি, প্রেসার, ও রাসায়নিক সংকেত সব মিলে তৈরি হয় এক সজীব তথ্যপ্রবাহ। বিজ্ঞানীরা এই সিস্টেমকে এখন আরও গভীরভাবে বুঝতে পারছেন। 

সম্প্রতি (এপ্রিল, ২০২৫) এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল PNAS-এ। গবেষকরা বলছেন, এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে এমন স্মার্ট গাছ তৈরি করা সম্ভব হবে, যেসব গাছ নিজেরাই সেন্সরের মাধ্যমে সংকেত পাঠিয়ে কৃষকদের জানাতে পারবে কখন তাদের পানি দরকার, কখন তাদের পরিচর্যা দরকার।

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এক শতাব্দী আগেই গাছের না বলা কথাগুলো ধরতে পেরেছিলেন তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্রের মাধ্যমে। আর আজকের বিজ্ঞান সেই না বলা কথাগুলোকে ধীরে ধীরে ভাষায় রূপান্তর করতে শিখছে। গাছেরা চুপচাপ থাকলেও, তাদের ভেতর দিয়ে প্রতিনিয়ত বইছে এক আশ্চর্য বার্তাবাহক স্রোত। বর্তমানের বিজ্ঞান এখন সেই বার্তার ভাষা বুঝে নেয়ার নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।

বিস্তারিত তথ্যের জন্য এখানে ক্লিক করুন:
https://phys.org/news/2025-04-century-mystery-communication-stress-negative.html

ছবি কৃতজ্ঞতা: Proceedings of the National Academy of Sciences (April, 2025)

Comments