অন্তর্ধান থেকে প্রত্যাবর্তন: ডায়ার উলফের ফেরা?

প্রাচীন পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়ানো এক কিংবদন্তির প্রাণী ডায়ার উলফ। নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা শিহরণ জাগে শরীরজুড়ে। “Game of Thrones”- মুভিতে যারা এই নামটা প্রথম শুনেছে, তারা জানে এই প্রাণীটা শুধুই একটা মিথ নয়। একসময় উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে রাজত্ব করা এক হিংস্র, দুর্দান্ত শিকারি প্রাণী ছিল এই ডায়ার উলফ। প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে বরফযুগের শেষদিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই আশ্চর্য নেকড়ের জাত।

কিন্তু আজ, ২১শ শতকে, বিজ্ঞানীরা যেন তাদের ঘুম ভেঙে জাগিয়ে তুলতে চাইছে! এবং এটা এখন আর কোনো কল্পনা নয়, এটা এখন বাস্তব।

৭ এপ্রিল ২০২৫, এক যুগান্তকারী সংবাদে টাইম ম্যাগাজিন জানায়, মার্কিন বায়োটেক কোম্পানি কলোসাল বায়োসায়েন্সেস সফলভাবে তিনটি ডায়ার উলফ-সদৃশ শাবকের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রথমে ১৩,০০০ বছর পুরনো একটি দাঁত এবং ৭২,০০০ বছর পুরনো একটি খুলি থেকে পাওয়া ডায়ার উলফের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেছেন। তারপর সেই ডিএনএর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানের ধূসর নেকড়ের কোষে ক্রিস্পার ক্যাস নাইন প্রযুক্তির মাধ্যমে কুড়িটি জিন এডিটিং করে, তিনটি ডায়ার উলফ-সদৃশ শাবক তৈরি করেছেন। এই তিনটি ছানার নাম দেয়া হয়েছে রোমুলাস, রেমুস, এবং খালিসি।  এই অসাধারণ ঘটনা শুধুই বিজ্ঞানের নয়, যেন এক আধুনিক রূপকথার গল্প।

এই প্রচেষ্টার নেপথ্যে রয়েছেন কলোসালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জেনেটিক্সের অধ্যাপক জর্জ চার্চ, যিনি বলেন, “ক্লোনিংয়ের এই ধারণাটি আমাদের কাছে গেম চেঞ্জার বলে মনে হয়েছে।” যদিও এ ব্যাপারে মূল বিবৃতি দেন কলোসালের সিইও বেন ল্যাম। তিনি বলেন, “এই তিনটি শাবক আমাদের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সাক্ষ্য।”

এই তিনটি শাবক বর্তমানে টেক্সাসের একটি নিরাপদ, অত্যাধুনিক ২,০০০ একর সংরক্ষিত পরিবেশে বসবাস করছে। সেখান থেকে ড্রোন এবং লাইভ ক্যামেরার মাধ্যমে তাদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে, যেন তারা সুস্থভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে।

তবে এই প্রকল্পকে "ডায়ার উলফ পুনরুজ্জীবন" বলা হলেও, তা প্রকৃত অর্থে ডি-এক্সটিংশন (de-extinction) নয়। কারণ, ডি-এক্সটিংশন বলতে বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে বিলুপ্ত প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ জিনোম পুনর্গঠন করে হুবহু সেই প্রজাতিকে জীবন্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। বর্তমান প্রকল্পটি মূলত একটি জিনগত রেট্রোফিটিং প্রক্রিয়া, যেখানে বর্তমানের নেকড়ের প্রজাতিকে জিনগতভাবে পরিবর্তন করে বিলুপ্ত প্রজাতির নেকড়ের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য কৃত্রিমভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

প্যালিওজেনেটিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েকটি জিনের পরিবর্তনে কোনো প্রজাতিকে ‘পুনর্জন্ম’ দেওয়া সম্ভব নয়, বিশেষত যখন সেই প্রজাতি তার বিবর্তনীয় শিকড়ে এতটাই আলাদা। ডায়ার উলফের পূর্ণাঙ্গ জিনোম না থাকা এবং তাদের জীববিজ্ঞানের বহু দিক অজানা থাকার কারণে একে সম্পূর্ণ ডি-এক্সটিংশন বলা যায় না।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি শুধুই একটা জৈবিক এক্সপেরিমেন্ট? কিন্তু এর পিছনে রয়েছে একটা গভীর দার্শনিক প্রশ্ন। আমরা কি সত্যিই কোনো প্রাণীকে তার অস্তিত্বের শেষসীমা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি? যদি পারিও, তবে সেটা কতটা নৈতিক? বর্তমান প্রাণীজগতের উপর এর প্রভাবই বা কী হবে? সমালোচকরা বলছেন, এটা এক ধরনের ‘ঈশ্বর খেলার’ প্রচেষ্টা। প্রকৃতি যা হারিয়েছে, মানুষ কি সেটা ফিরিয়ে আনার অধিকার রাখে?

তবু একে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক দৃষ্টান্তমূলক প্রচেষ্টা হিসেবে ধরা যায়, যেখানে প্রাচীন জীববিদ্যা, আধুনিক জেনেটিক্স এবং সিন্থেটিক বায়োলজির সংমিশ্রণে ভবিষ্যতের গবেষণার দরজা খুলে যাচ্ছে। এই পথের সঠিক নৈতিক ও জৈব-প্রযুক্তিগত ব্যবহার নিশ্চিত করাই হবে আগামী দিনের মূল চ্যালেঞ্জ।

Comments