আজকাল জিনোম এডিটিং বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে বহু জটিল ও জেনেটিক রোগের স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে। মানুষের আয়ু বৃদ্ধি, জিনগত দুর্বলতা নিরসন এবং কৃষিক্ষেত্রে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব ঘটানো—সবই আজ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সম্ভব হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, আমাদের খুব কাছেই অপেক্ষা করছে এক 'বায়োলজিক্যাল মিরাকেল'। আর এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হতে চলেছে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি।
জিনোম এডিটিং বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ডিএনএ অণুর গঠন সম্পর্কে। ডিএনএ (DNA) বা ডিঅক্সি রাইবো নিউক্লিক এসিড হচ্ছে জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক। ডিএনএ মূলত জীবকোষের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোসোমের মধ্যে অবস্থান করে। ডিএনএ অণু দুটো পরস্পর জড়ানো সুতোর মতো পেঁচিয়ে থাকে, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ডবল হিলিক্স। এই কাঠামোটি গঠিত হয়েছে ডিঅক্সি রাইবোস সুগার, ফসফেট এবং চার ধরনের নাইট্রোজেন বেইস—অ্যাডেনিন (A), থায়ামিন (T), গুয়ানিন (G) এবং সাইটোসিন (C)—দিয়ে। A সবসময় জোড় বেঁধে থাকে T এর সাথে, আর C জোড় বেঁধে থাকে G এর সাথে। এই বেইসগুলোর বিন্যাসই নির্ধারণ করে জীবদেহের সমস্ত বৈশিষ্ট্য।
জিনোম বলতে বোঝানো হয় কোন জীবের সামগ্রিক ডিএনএ বিন্যাসকে। মানুষের জিনোমে প্রায় তিন বিলিয়ন বেইস জোড় রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার জিন চিহ্নিত হয়েছে। এই জিনগুলোই মানব দেহের যাবতীয় প্রোটিন তৈরির এবং নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেয়। তবে সম্পূর্ণ জিনোমের খুব সামান্য অংশই প্রকৃত অর্থে জিন। জিনোমের ভেতর থেকে জিনগুলোকে রীতিমতো খুঁজে বের করতে হয়। জিনোমের বাকিটা হলো নন-কোডিং ডিএনএ, যার কার্যকারিতা এখনও বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়।
জিনোমের ভিতরে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটালে জীবের বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তন করা সম্ভব। এটি অনেকটা ওয়ার্ড প্রসেসরে লেখা সম্পাদনার মতো। যেখানে কোনো অক্ষর বা শব্দ বদলে একটি লেখাকে সম্পূর্ণ নতুন রূপ দেওয়া যায়। ঠিক তেমনই, বিজ্ঞানীরা এখন এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন যার মাধ্যমে ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশকে কেটে, পাল্টে বা বাদ দিয়ে সেখানে নতুন জিন বসানো যায় কিংবা কোনো ক্ষতিকর জিনকে নিষ্ক্রিয় করা যায়। এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয়, জিনোম এডিটিং।
বর্তমানে জিনোম এডিটিংয়ের সবচেয়ে কার্যকর ও বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি হলো, ক্রিসপার ক্যাস নাইন (CRISPR/Cas9)। এই প্রযুক্তিটি আবিষ্কারের জন্য ২০২০ সালে ইম্যানুয়েল শার্পেনটিয়ার ও জেনিফার ডোডনা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ক্রিসপার প্রযুক্তি মূলত ব্যাকটেরিয়ার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।
এখন দেখে নেয়া যাক, ক্রিসপার ক্যাস নাইন প্রযুক্তিটি কিভাবে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ব্যাক্টেরিয়ার জিনোমে কিছু কিছু সিকোয়েন্স আছে, যার মধ্যে অনেকগুলো পুনরাবৃত্তি থাকে। এদেরকে বলে ক্রিসপার (CRISPR - এর পুরো নাম, Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeat)। এটি আসলে প্রকৃতিতে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরক্ষা হিসাবে কাজ করে। ব্যাকটেরিয়া যখন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এই ক্রিসপার সিকোয়েন্স থেকে কিছু প্রোটিন উৎপন্ন হয়। এই প্রোটিনগুলো ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে। এই ক্রিসপার প্রোটিনগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে Cas9 । যদিও Cas9 প্রোটিনের কাজ হলো ভাইরাসকে আক্রমণ করা কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন একে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন কাজে লাগাচ্ছেন। আর এই কাজটি হলো জিনোম এডিটিং করা।
তাঁরা Cas9 প্রোটিনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন ছোট্ট একটি গাইড আরএনএ (gRNA) অণু। এই অণুটিতে মাত্র গোটা বিশেক বেইস জোড় থাকে। এই গাইড আরএনএর কাজ হলো জিনোম এডিটিং করার জন্য টার্গেট জিনটিকে শনাক্ত করা। গাইড অণুটিকে এমনভাবে তৈরী করা হয় যাতে এটি শুধুমাত্র টার্গেট জিনটির সাথেই যুক্ত হতে পারে। আর টার্গেট জিনটি পাওয়া মাত্র Cas9 প্রোটিন জিনোমের ডিএনএকে কেটে দু'ভাগ করে ফেলে। তখন প্রাকৃতিক নিয়মেই ডিএনএ নিজেকে আবার জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে। আর এই সুযোগে বিজ্ঞানীরা সেখানে জুড়ে দিতে পারেন তাদের পছন্দের জিন অথবা নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন কোনো ক্ষতিকর জিনকে।
এই প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট, তুলনামূলকভাবে সহজ এবং ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বজুড়ে এটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। গবেষকরা এখন ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধান, গম, ভুট্টা, সয়াবিন প্রভৃতি শস্যে রোগপ্রতিরোধী জিন স্থাপন করছেন, উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছেন এবং জলবায়ু সহনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তাঁরা গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত তৈরির জন্য ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এর পাশাপাশি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপযোগী নিম্ন গ্লাইসেমিক ধানের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা চলছে।
মানব চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ক্রিসপার প্রযুক্তি এক সম্ভাবনাময় বিপ্লব নিয়ে এসেছে। সিকল সেল অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, কিছু ক্যান্সার ও জন্মগত অন্ধত্বের চিকিৎসায় ইতিমধ্যে এই প্রযুক্তির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনস্ট্রেশন (FDA) অনুমোদিত প্রথম ক্রিসপার ভিত্তিক জিন থেরাপি "Exa-cel" বাজারে আসে, যা সিকল সেল ও বিটা থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
তবে ক্রিসপার প্রযুক্তির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। বিশেষ করে ডিএনএ কাটাকাটির ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত মিউটেশনের ঝুঁকি থেকেই যায়। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বিজ্ঞানীরা আরও নির্ভুল ও সূক্ষ্ম প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে গেছেন। এর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হলো বেস এডিটিং এবং প্রাইম এডিটিং।
বেস এডিটিং প্রযুক্তিতে ডিএনএ কাটার দরকার পড়ে না। বরং নির্দিষ্ট একটি বেইসকে সরাসরি আরেকটি বেইসে রূপান্তর করা যায়।যেমন A থেকে G বা C থেকে T। এটি অনেক বেশি নিরাপদ ও কার্যকর, বিশেষত যেখানে খুব ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দরকার হয়।
অন্যদিকে, প্রাইম এডিটিং বেস এডিটিংয়ের চেয়েও উন্নত। এখানে গাইড আরএনএর সঙ্গে যুক্ত থাকে "রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ" নামের একটি এনজাইম, যেটা ডিএনএ-তে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন (বেস পরিবর্তন, ইনসারশন বা ডিলিশন) ঘটাতে সক্ষম। যদিও এখনো এটি গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে, ভবিষ্যতের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ও নিরাপদ জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি হিসেবে এটি বিবেচিত হচ্ছে।
তবে এইসব উজ্জ্বল সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে নৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন। ২০১৮ সালে চীনা গবেষক হি জিয়ানকুই ঘোষণা দেন, তিনি মানব ভ্রূণে ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ক্ষতিকর জিনকে (CCR5) নিষ্ক্রিয় করেছেন এবং সেই ভ্রূণ থেকে জন্ম হয়েছে দুটি শিশু—লুলু ও নানা। বৈজ্ঞানিক সমাজে এ ঘটনা প্রবল সমালোচনার জন্ম দেয় এবং মানব ভ্রূণের জিনোম এডিটিংয়ের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও নৈতিকতা নিয়ে গভীর বিতর্ক শুরু হয়। পরবর্তীতে হি জিয়ানকুইকে চীনা সরকার কারাদণ্ড দেয়। বর্তমানে মানব জিনোমে এই প্রযুক্তির ব্যবহারে বিশ্বজুড়ে নীতিগত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
মোট কথা, জিনোম এডিটিং এখন আর ভবিষ্যতের কল্পনা নয়, বরং বর্তমানের বাস্তবতা। ক্রিসপার ক্যাস নাইন, বেস এডিটিং ও প্রাইম এডিটিংয়ের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আজ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে নতুন এক জৈবিক ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যেমন রোগ নিরাময়, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণে অভূতপূর্ব সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, তেমনি এটি নৈতিকভাবে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার এক গুরুদায়িত্বও দিয়ে গেছে।
জীবনের পাঠ্যবইয়ে মানুষের কলম ধরার আগে, দরকার গভীর বিচার-বিবেচনা বোধ, মানবিক সংবেদনশীলতা এবং সেই সাথে প্রয়োজন এ ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা।
© তানভীর হোসেন
Comments