সময় থেকেই স্থানের জন্ম?

ছাত্র জীবন থেকেই শুনে এসেছি, মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে স্থান ও সময় দিয়ে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বেও বলা হয়েছে, স্থান ও সময় একসাথে গাঁথা হয়ে তৈরি করেছে “স্পেস-টাইম” বা "স্থান-কাল" নামের এক চতুর্মাত্রিক কাঠামো, যেখানে ঘটছে আমাদের অস্তিত্বের সমস্ত ঘটনা। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, এই ধারণা হয়তো পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে, স্থান আসলে সময় থেকেই জন্ম নিয়েছে।

গত ৮ এপ্রিল ২০২৫, নিউ সায়েন্টিস্টে প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধে এই নতুন ধারণার কথাই উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সময় হতে পারে এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। আর স্থান, অর্থাৎ যেখানে আমরা অবস্থান করি, দৃশ্যমান বিশ্বকে দেখি, চলাফেরা করি—সেটা হতে পারে সময়েরই এক ধরনের বিকাশ বা পরিণাম। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের শুরুতে ছিল কেবল "সময়", আর সময়ের বুক থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে "স্থান"।

এই ধারণার পেছনে রয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি অত্যন্ত মৌলিক ধারণা—কিউবিট। কিউবিট বা কোয়ান্টাম বিট হলো বস্তুকণার এমন অবস্থা, যার দুইটি ভিন্ন রূপ থাকতে পারে।যেমন, আপ-স্পিন ও ডাউন-স্পিন। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের অবাক বিস্ময় হলো, কিউবিট একইসাথে উভয় অবস্থায় থাকতে পারে, এটা এক ধরনের ভারসাম্যহীন ‘মিশ্রাবস্থা’য়—যাকে বলা হয় সুপারপজিশন (superposition)।  গবেষকরা একটি একক কিউবিট সময়ের মধ্য দিয়ে কিভাবে পরিবর্তিত হয়, সেই আচরণ বিশ্লেষণ করে এক আশ্চর্য রকমের জ্যামিতিক নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। যেটি অবিকল মনে করিয়ে দেয় একটি তিন-মাত্রিক স্থানের গঠন। অর্থাৎ, সময়ের প্রবাহের মধ্যেই যেন এক ধরনের স্থানিক বিন্যাস বা কাঠামো ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরছে।

এটা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার নিয়ম (uncertainty principle) এবং মহাবিশ্বের প্রসারণ হার—এই দুটি বিষয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক খতিয়ে দেখেছেন। তাঁরা দেখাচ্ছেন, যদি আমরা সময়কে খুব নির্দিষ্টভাবে বুঝতে পারি, তাহলে মহাবিশ্বের প্রসারণ হার অনিশ্চিত হয়ে যায়। আবার যদি প্রসারণ হার নির্দিষ্ট হয়, তাহলে সময়ের প্রবাহটাই ধোঁয়াটে হয়ে যায়। ঠিক যেমনি ভাবে, কোয়ান্টাম জগতে কণার অবস্থান ও গতি একসাথে নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায় না, তেমনি স্থান-সময়ের ক্ষেত্রেও এমন এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা যায়।

এই গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো—স্থান আসলে সময়ের একটি ‘পর্যায় পরিবর্তন’ (phase transition)। যেমন পানি থেকে বরফ তৈরি হয়, বা তরল থেকে গ্যাস, তেমনি একটি নির্দিষ্ট স্তরে সময়ের মাঝে এক ধরনের রূপান্তর ঘটে, যেখান থেকে স্থান “উদ্ভূত” হয়। এটা অনেকটা এমন কল্পনা করা যায়, সৃষ্টির আদিতে ছিল কেবল একটা স্রোত, একটানা বয়ে চলা সময়ের ধারা—আর সেখান থেকেই ঢেউয়ের মত গড়ে উঠতে শুরু করল স্থান, আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান জগৎ।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিগ ব্যাং-এর আগে কোনও স্থান ছিল না। ছিল শুধু কেবল সময়ের ধারা। অর্থাৎ মহাবিশ্বের শুরুটা ছিল এক ধরণের "ভয়েড" বা শূন্যতা, যেখান থেকে এক মুহূর্তে স্থানের উদ্ভব হয়, মহাবিশ্ব প্রসারণ শুরু করে, আর আমরা ধীরে ধীরে সেই বাস্তবতার ভেতর জন্ম নিই।

তবে এই নতুন তত্ত্ব এখনো পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত নয়। এটি মূলত গাণিতিক মডেল আর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। বিজ্ঞানীরা এই ধারণা আরও যাচাই-বাছাই করছেন, এবং ভবিষ্যতে যদি কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনও পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে এই তত্ত্ব বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। তখন 

এই পুরো ভাবনাটাই আমাদের মহাবিশ্বকে দেখার চোখ বদলে দিতে পারে। আমরা এতদিন যে ত্রিমাত্রিক বাস্তবতাকে পাথরের মত শক্ত, নির্ভরযোগ্য ও চিরন্তন ভেবে এসেছি সেটা যদি সত্যিই মহাকালের মধ্য থেকে জন্ম নিয়ে থাকে, তাহলে সময়ই হবে আমাদের সবচেয়ে মৌলিক বাস্তবতা। স্থান, বস্তু, এমনকি আমাদের অস্তিত্ব—সবই সময়ের বুননে তৈরি এক মহাকাব্যের অংশ।

মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরন্তন। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু মৌলিক ধারণা উঠে আসে, যেগুলো আমাদের পুরনো প্রশ্নগুলোরই নতুন ব্যাখ্যা দেয়। “সময় থেকেই স্থানের জন্ম" এই বৈপ্লবিক ধারণাটি ঠিক তেমনই এক জিজ্ঞাসা, যা ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, দর্শন ও কল্পনার জগতে এক নতুন আলো ফেলতে পারে।

ছবি সৌজন্য: সাইন্স ফটো লাইব্রেরি।