স্ট্রিং থিওরি: মহাবিশ্বের সূক্ষ্ম সংগীত

সময়টা ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাস। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে একটি চিঠি এসেছে। চিঠির সাথে রয়েছে বেশ কিছু জটিল সমীকরণ। চিঠিটি লিখেছেন থিওডোর কালুৎজা নামে একজন গণিতবিদ। বিজ্ঞানী সমাজে তিনি তেমন পরিচিত কেউ নন। অথচ তাঁর সমীকরণে চোখ বুলিয়ে আইনস্টাইন অবাক হয়ে গেলেন। খুবই চমকপ্রদ একটি ধারণার সন্ধান পেলেন তিনি।
বিজ্ঞানী হিসেবে আইনস্টাইনের খ্যাতি তখন বিশ্বজোড়া। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ‌তিনি তাঁর তত্ত্বে স্থান, কাল এবং বস্তুকে এক সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও স্থান এবং কালকে আমরা আলাদা মনে করি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বে স্থান এবং কাল একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। স্থান-কালের যৌথ বুননেই মহাবিশ্বের অবকাঠামো গঠিত হয়েছে।
আইনস্টাইন বললেন, বস্তুর উপস্থিতির জন্য স্থান-কালের বুননের মধ্যে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কৃত মহাকর্ষ বলকে তিনি সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যাখ্যা করলেন।‌ সপ্তদশ শতাব্দীতে নিউটন বলেছিলেন, যে বস্তুর ভর যত বেশি তার মহাকর্ষ বলও তত প্রবল। বিংশ শতাব্দীতে এসে আইনস্টাইন একটি সম্পূর্ণ নতুন কথা শোনালেন। তিনি বললেন, বস্তুর ভরের কারণে তার চারপাশে স্থান-কালের বুননের মধ্যে যে বক্রতার সৃষ্টি হয়, সেটাই হলো মহাকর্ষ বলের উৎস। যে বস্তুর ভর যত বেশি, তার চারপাশে স্থান-কালে বক্রতার পরিমাণও তত বেশি, এবং সেজন্যই তার মহাকর্ষ বলও তত বেশি। এভাবে মহাকর্ষের যুগান্তকারী ব্যাখ্যা আইনস্টাইনের আগে কেউ দেননি।

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন কালুৎজার চিঠিটি পড়ে খুব অবাক হলেন। তিনি দেখলেন, কালুৎজা সাধারণ আপেক্ষিকতার ধারণাটিকে মহাকর্ষ ছাড়িয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ‌কালুৎজা তাঁর সমীকরণে অতিরিক্ত আরেকটি মাত্রার আশ্রয় নিয়েছেন। এই অতিরিক্ত মাত্রা যুক্ত করার ফলে, ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বকত্বের সমীকরণগুলি আপনা-আপনি উঠে এসেছে তাঁর কাঠামোর ভেতর থেকে। মোদ্দা কথা হলো, এর মাধ্যমে তিনি মহাকর্ষ ও তড়িৎচুম্বকীয় বল—এই দুটি প্রাকৃতিক বলের মধ্যে একটি গাণিতিক সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।

কালুৎজার পাঁচ মাত্রার সমীকরণে আইনস্টাইন কোন ভুল দেখতে পেলেন না। কিন্তু পঞ্চম মাত্রাটির প্রকৃতি সম্পর্কে কালুৎজা নিজে কিছু বলেননি, এবং আইনস্টাইনও তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। পরবর্তীতে, ১৯২৬ সালে, অস্কার ক্লাইন নামে একজন বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা দেন, এই অতিরিক্ত মাত্রাটি এতই ক্ষুদ্র এবং গুটানো অবস্থায় রয়েছে যে আমাদের চোখে বা কোন যন্ত্রে তা ধরা পড়ে না। এই মাত্রাটি প্রকৃতিতে রয়েছে, সম্পূর্ণ আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। কালুৎজা এবং ক্লাইনের প্রস্তাবিত এই ধারণাটিই ছিল স্ট্রিং থিওরির প্রাথমিক ভিত্তি।

বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির রহস্য ভেদ করতে চান। তাঁরা চান বস্তুকণার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে। এই জগতের নিয়ামক হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স। গত পঞ্চাশ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নানান তত্ত্ব ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা পদার্থের মৌলিক রূপটি কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। তাঁরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর ভিত্তি করে বস্তুকণার একটি স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়েছেন। এই মডেল দিয়ে বস্তুকণার মূল চরিত্র তথা পদার্থের স্বরূপ অনেকটাই ব্যাখ্যা করা যায়।
কিন্তু সমস্যা হলো, স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে বস্তুকণার চরিত্র ব্যাখ্যা করা গেলেও, মহাকর্ষ বলের কোনও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। এর জন্য বিজ্ঞানীদের আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শরণাপন্ন হতে হয়। সোজা কথায় বলতে হয়, প্রকৃতির সকল নিয়ম ব্যাখ্যার জন্য স্ট্যান্ডার্ড মডেলই যথেষ্ট নয়। এর বাইরেও অজানা বহু রহস্য লুকিয়ে আছে।

এই রহস্যের খোঁজ করতে গিয়ে, একদল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী পদার্থের গঠনের একটি নতুন ও পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন স্ট্রিং থিওরির মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা পদার্থের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুই মূলত দুই ধরনের মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি—কোয়ার্ক ও লেপ্টন। কিন্তু স্ট্রিং থিওরির প্রবক্তারা বলেন, এটিই শেষ কথা নয়। কোয়ার্ক ও লেপ্টনের ভেতরে রয়েছে আরও সূক্ষ্ম এক ধরনের স্ট্রিং বা তন্তু। এই স্ট্রিংগুলো পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চেয়েও বহু কোটি কোটি গুণ ছোট। স্ট্রিং থিওরি মতে, পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক কোনো কণা নয়, বরং একটি অতিক্ষুদ্র একমাত্রিক কম্পমান স্ট্রিং। এদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৬ × ১০⁻^৩৫ মিটার, যা “প্ল্যাঙ্ক লেংথ” নামে পরিচিত। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নাম অনুসারে এর নামকরণ হয়েছে। এই দৈর্ঘ্যের নিচে বস্তু আর ক্লাসিকাল অর্থে "বস্তু" থাকে না, সেখানে কেবল সম্ভাবনার গাণিতিক তরঙ্গ খেলে। গিটারের তারের মতো, এই স্ট্রিংগুলো কম্পনের ফলে বিভিন্ন অনুরণন সৃষ্টি করে, যা বাইরে থেকে বিভিন্ন বস্তুকণা রূপে প্রকাশ পায়।
স্ট্রিংয়ের কম্পনের ধরন অনুযায়ীই নির্ধারিত হয় কণার বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এক ধরনের কম্পনে লেপ্টন তৈরি হয়, অন্য কম্পনে কোয়ার্ক। ফলে, এদের গঠনের উৎস অভিন্ন হলেও, কম্পনের তারতম্যই তাদের আলাদা করে তোলে।

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা পাঁচটি ভিন্ন ধরনের স্ট্রিং থিওরি দাঁড় করান। কিন্তু এগুলো একে অপরের সঙ্গে গাণিতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। পরে, ১৯৯৫ সালে মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইটেন এগুলোকে একটি বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে একীভূত করার প্রস্তাব দেন। এই একত্রীকৃত কাঠামোর নামই হল এম থিওরি (M-Theory)—এটি বর্তমানে স্ট্রিং থিওরির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রূপ।

এম থিওরির কাঠামো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা গাণিতিকভাবে দেখিয়েছেন, মহাবিশ্বে মোট ১১টি মাত্রা (ডাইমেনশন) রয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের পরিচিত তিনটি স্থানিক মাত্রা এবং একটি সময়মাত্রা ছাড়াও আরও সাতটি অতিরিক্ত মাত্রা গুটিয়ে আছে। এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলোর সম্ভাব্য গঠনকে বলা হয়, কালাবি-ইয়াউ স্পেস। এটি একটি জটিল, বহু-ভাঁজবিশিষ্ট জ্যামিতিক কাঠামো। এই গঠনের উপর নির্ভর করে স্ট্রিংগুলোর কম্পনের ধরন এবং সেই অনুযায়ী কণাগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়।
এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো এতটাই সূক্ষ্ম ও গুটানো অবস্থায় থাকে যে আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। এমনকি আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টিকেল অ্যাক্সেলারেটর দিয়েও এই মাত্রাগুলোর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি।

স্ট্রিং থিওরিতে একটি বিশেষ কণার কথা বলা হয়েছে, যার ভর শূন্য, কিন্তু স্পিন দুই। এর নাম, গ্র্যাভিটন। এটি একটি বোসন, অর্থাৎ বলবাহক কণা। স্ট্রিং থিওরি অনুসারে, গ্র্যাভিটন হলো সেই কণা, যা মহাকর্ষ বল বহন করে।

স্ট্রিং থিওরিতে দুই ধরনের স্ট্রিং-এর কথা বলা হয়—ক্লোজ স্ট্রিং ও ওপেন স্ট্রিং। ক্লোজ স্ট্রিংগুলো একটি বৃত্তের মতো, যাদের কোনো প্রান্ত নেই, এবং তারা স্থান-কাল জুড়ে মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্র্যাভিটনের মতো বল বহনকারী কণাগুলো ক্লোজ স্ট্রিং থেকে উৎপন্ন হয়েছে। অন্যদিকে ওপেন স্ট্রিংয়ের দুইটি প্রান্ত থাকে, যা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, ওপেন স্ট্রিং থেকেই তড়িৎচুম্বক, দুর্বল ও শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের কণাগুলো তৈরি হয়েছে।

তবে স্ট্রিং থিওরির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো—এটি এখনো পর্যবেক্ষণভিত্তিক বা পরীক্ষালব্ধভাবে প্রমাণিত হয়নি। এই তত্ত্ব এখনো গাণিতিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। স্ট্রিংগুলো এতটাই ছোট যে, তাদের অস্তিত্ব বোঝার জন্য প্রয়োজন প্ল্যাঙ্ক শক্তি—যা হল প্রায় ১.২২ × ১০^১৯ ইলেকট্রন ভোল্ট। এত শক্তিশালী পার্টিকেল এক্সেলারেটর বর্তমান প্রযুক্তিতে তৈরি করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

তাছাড়া এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলোর গঠন নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে স্ট্রিং থিওরিকে সরাসরি যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন। তবুও বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। কারণ, স্ট্রিং থিওরি একমাত্র তত্ত্ব যা একইসঙ্গে মহাকর্ষ ও কোয়ান্টাম বলগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারে। সুতরাং এটিই হতে পারে সেই বহু প্রতীক্ষিত “থিওরি অফ এভরিথিং”, যা প্রকৃতির সব শক্তি ও কণাকে একত্রে বর্ণনা করতে পারবে।

স্ট্রিং থিওরির অন্যতম গবেষক মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী মিচিও কাকু একে একটি সংগীতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, “স্ট্রিংয়ের সম্মিলিত কম্পনে যে সুর সৃষ্টি হয়েছে, সেটিই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা, প্রতিটি কণা-গুচ্ছ, এমনকি আমাদের অস্তিত্বের পেছনে দায়ী। মহাবিশ্ব একটি বিশাল সিম্ফোনি, আর আমরা সবাই তার নোট মাত্র।”

তবে বিজ্ঞানের প্রতিটি তত্ত্বকে পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হয়, স্ট্রিং থিওরিও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রমাণ ছাড়া কোনো তত্ত্বই বিজ্ঞানে চূড়ান্ত নয়। আর এই কারণেই, এই তত্ত্বের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে প্রযুক্তির অগ্রগতির উপর।

© তানভীর হোসেন

Comments