মেন্ডেলের মটরশুঁটির রহস্যভেদ


গত ২৩ এপ্রিল ২০২৫, বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে একটি বিস্ময়কর গবেষণায় কথা প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি করা হয়েছে মটরশুঁটি নিয়ে মেন্ডেলের সেই ঐতিহাসিক কাজের উপর ভিত্তি করে।

জেনেটিক্সের জনক গ্রেগর জোহান মেন্ডেল (১৮২২ -১৮৮৪) পেশাগতভাবে বিজ্ঞানী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক। অথচ বিজ্ঞানীদের মতই নিবিড় পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণে তিনি ছিলেন বিশ্বাসী । মটরশুঁটি নিয়ে নিতান্ত শখের বসেই দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আশ্চর্য কিছু জিনিস তিনি লক্ষ্য করেছিলেন।

সময়টা ছিল ১৮৫৬ সাল। মেন্ডেলের চোখে পড়লো মটরশুঁটির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পরবর্তী প্রজন্মে প্রকাশ পাচ্ছে। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি দেখালেন,  বংশগতির এই ধারা আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় অদৃশ্য কিছু উপাদান বা 'ফ্যাক্টর' দিয়ে। যাকে আজ আমরা চিনি ‘জিন’ হিসেবে। 

যদিও জিনের গঠন নিয়ে মেন্ডেলের কোন ধারণাই ছিল না।
কিন্তু মেন্ডেলের এই গবেষণা হলো আধুনিক জেনেটিক্সের ভিত্তি। তিনি মটরশুঁটির সাতটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছিলেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক গবেষণায়। পরবর্তীতে সেই সাতটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্যের জেনেটিক কারণ সহজেই ব্যাখ্যা করা গিয়েছিল। যেমন, গাছের উচ্চতা, ফুলের রঙ, বীজের রং এবং বীজের আকৃতি।  

কিন্তু এত বছর পরেও সাতটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বাকি তিনটি বৈশিষ্ট্যের আসল জিন কোনটি, সেটা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেননি। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, মেন্ডেল কি শুধুই সৌভাগ্যক্রমে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বেছে  নিয়েছিলেন, নাকি এর পেছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে?

নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দীর্ঘদিনের এই অমীমাংসিত  প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। প্রায় ৭০০ জাতের মটরশুঁটির জিনোম বিশ্লেষণ করে একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী অবশেষে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন সেই তিনটি অজানা জিন। এই জিনগলো খুঁজে বের করতে তাঁদেরকে বিশাল পরিশ্রম করতে হয়েছে।  মটরশুঁটির প্রায় ১৫ কোটি জিনগত ভিন্নতা খুঁটিয়ে দেখতে হয়েছে। অবশেষে দীর্ঘ গবেষণার পর তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন সেই তিনটি ‘হারিয়ে যাওয়া’ জিন। এ যেন ইতিহাসের সাথে বিজ্ঞানের এক অনন্য সাক্ষাৎ। 

এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করতে পেরেছেন মটরশুঁটির সেই  তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পেছনের জিনগুলোকে:

১. শুঁটির রঙ কিভাবে ঠিক হয়?

শুঁটির সবুজ বা হলুদ রঙের পেছনে কাজ করছে এমন একটি জিন, যেটি ক্লোরোফিলের উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে। ক্লোরোফিল হচ্ছে সেই উপাদান, যেটা উদ্ভিদকে সবুজ করে তোলে। যখন এই জিনটি সক্রিয় থাকে না, তখন শুঁটি ক্লোরোফিল ধরে রাখতে পারে না।ফলে তা হয়ে যায় হলুদ।

২. শুঁটির গঠন মসৃণ না কুঁচকানো?

এর পেছনে আছে এমন এক জিন, যা কোষ বিভাজনের সময় কোষের প্রাচীর ও পানি ধারণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। যদি এই জিনটি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে কোষগুলোর মধ্যে অসমান বিভাজনের কারণে শুঁটি কুঁচকে যায়।

৩. ফুলের বিন্যাস কিভাবে হয়? 

মটরশুঁটি গাছের ফুলগুলো একসঙ্গে গুচ্ছে ফুটবে নাকি আলাদা থাকবে, তা নির্ভর করছে একটি বিশেষ জিনের ক্ষুদ্র অংশের উপস্থিতির ওপর। এই জিনের একটি অংশ উপস্থিত না থাকলে ফুলের গুচ্ছ আলাদা হয়ে যায়।

এই গবেষণার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা শুধু ইতিহাসের একটি খোলা অধ্যায়কে বন্ধই করলেন না, বরং আধুনিক উদ্ভিদ প্রজননকেও একটি নতুন মাত্রা দিলেন। তারা প্রমাণ করলেন, উদ্ভিদের জিনোম বিশ্লেষণ করে 
যে কোন প্রয়োজনীয় জিনের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। এর ফলে, উচ্চ ফলনশীল, পুষ্টিকর এবং টেকসই জাতের উদ্ভিদ প্রজনন করে জলবায়ু পরিবর্তনের মত বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কাজটি সহজতর হবে বলে আশা করা যায়। 

এই গবেষণা একদিকে যেমন মেন্ডেলের ঐতিহাসিক কীর্তিকে পূর্ণতা দিল, অন্যদিকে ভবিষ্যতের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও হয়ে উঠল এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এই গবেষণা নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
 
https://www.nature.com/articles/d41586-025-01269-8

Comments