পদার্থের স্বরূপ: স্ট্যান্ডার্ড মডেল


বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, পদার্থ গঠনের মৌলিক উপাদান হলো মাত্র তিনটি কণা—প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রন। নিউট্রন ও প্রোটন থাকে পরমাণুর কেন্দ্রে, আর তাদের চারপাশে ঘুরছে ইলেকট্রন। ব্যস, এটাই ছিল এককথায় পদার্থের ভেতরের ছবি—সরল, সুবিন্যস্ত এবং সহজবোধ্য।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে সবকিছু বদলে গেল। পার্টিকেল এক্সেলারেটরের বদৌলতে বিজ্ঞানীরা পরমাণুকে ভেঙে দেখতে শুরু করলেন আরও গভীরে। আর তখনই একে একে দেখা দিতে শুরু করল অসংখ্য ক্ষণস্থায়ী, রহস্যময় কণার আনাগোনা। পদার্থের সেই সরল সোজা ছবিটি যেন ভেঙে পড়ল জটিল বাস্তবতার ভারে। এই নতুন বাস্তবতাকে বোঝার জন্য বিজ্ঞানীদের নির্ভর করতে হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর। গত পঞ্চাশ বছরে অসংখ্য গবেষণা আর পরীক্ষার ভিত্তিতে তাঁরা তৈরি করলেন নতুন এক নকশা, যার নাম বস্তুকণার স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই তত্ত্ব দিয়ে আমরা পদার্থের স্বরূপকে ব্যাখ্যা করতে পারি নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে।

এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে, মহাবিশ্বের যাবতীয় দৃশ্যমান পদার্থ মূলত দুই ধরনের মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত—কোয়ার্ক ও লেপ্টন। কোয়ার্ক তৈরি করে পরমাণুর কেন্দ্রের প্রোটন ও নিউট্রন কণাকে, আর লেপ্টন শ্রেণির কণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো ইলেকট্রন।

কোয়ার্কের মোট ছয়টি ধরন রয়েছে, তিনটি জোড়া হিসেবে ভাগ করা যায়: আপ-ডাউন, চার্ম-স্ট্রেঞ্জ, টপ-বটম। আর লেপ্টনের ক্ষেত্রেও একই রকম তিনটি জোড়া: ইলেকট্রন ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউওন ও মিউওন নিউট্রিনো, টাও এবং টাও নিউট্রিনো।

এই কোয়ার্ক ও লেপ্টন কণাগুলোর সম্মিলিত নাম ফার্মিয়ন। এদের নাম এসেছে বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নাম থেকে। ফার্মিয়নরা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান অনুসরণ করে। এদের স্পিন ১/২, এরা পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলে। অর্থাৎ একই কোয়ান্টাম অবস্থানে দুটি ফার্মিয়ন কণা থাকতে পারে না।

ফার্মিয়নদের আবার তিনটি জেনারেশনে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম জেনারেশনের কণাগুলো (আপ এবং ডাউন কোয়ার্ক, ইলেকট্রন ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো) সবচেয়ে স্থিতিশীল। আমাদের চারপাশের জগতে এদের উপস্থিতি সর্বত্র। প্রোটনের মধ্যে থাকে দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক (মোট চার্জ +১)। নিউট্রনে থাকে একটি আপ ও দুটি ডাউন কোয়ার্ক (মোট চার্জ ০)।

ফার্মিওনের দ্বিতীয়  জেনারেশনের কণাগুলো হলো চার্ম এবং স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক, মিউওন ও মিউওন নিউট্রিনো। এরা ক্ষণস্থায়ী ফার্মিওন। উচ্চশক্তির পরমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষায় এদের দেখা মেলে। 

তৃতীয় জেনারেশনের ফার্মিয়নে রয়েছে টপ এবং বটম কোয়ার্ক, টাও আর টাও নিউট্রিনো লেপ্টন জুটি। এরাও অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ফার্মিয়ন, এদের দেখা শুধুমাত্র পাওয়া যায় অতি উচ্চ শক্তির পরমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষায়।  

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বল বা ফোর্স। মহাবিশ্বে চারটি মৌলিক বল রয়েছে: স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স, উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স এবং গ্রাভিটেশনাল ফোর্স। এই বলগুলোর সংযোগ রক্ষা করে বোসন নামক আরেক শ্রেণির কণা। বোসনদের নামকরণ করা হয়েছে বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম অনুসারে। এরা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। এদের স্পিন পূর্ণ সংখ্যার (০, ১, ২)। এরা পাউলির বর্জন নীতি মানে না। অর্থাৎ একই অবস্থানে একাধিক বোসন থাকতে পারে।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের চারটি বোসন হলো:

১. গ্লুওন – স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সের বাহক। এটি কোয়ার্কগুলিকে প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে বেঁধে রাখে।

২. ফোটন – ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের বাহক। আলো, এক্স-রে, রেডিও তরঙ্গ—সবই ফোটনের বহিঃপ্রকাশ।

৩. W ও Z বোসন – উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের বাহক। এই বল নিউট্রনকে প্রোটনে রূপান্তর করতে পারে, ফলে নিউক্লিয়াসে তেজস্ক্রিয়তা জন্ম নেয়।

৪. হিগস বোসন – বস্তুকণাদের ভরের উৎস। এর স্পিন শূন্য। ২০১২ সালে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে এই কণার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। একে অনেকেই বলেন "গড পার্টিকেল"।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, হিগস বোসনের স্পিন শূন্য কেন? কারণ, স্পিন থাকা মানেই হচ্ছে কণাটির গতি আছে এবং তা ভরবেগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু হিগস কণা ভরের উৎস হলেও ভরবেগ সৃষ্টি করে না। তাই এর স্পিন শূন্য। এটি একমাত্র স্কেলার বোসন।

তবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো, এটি গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ বলের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। গ্র্যাভিটি ব্যাখ্যার জন্য এখনো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করতে হয়। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, গ্র্যাভিটন নামে এক হাইপোথেটিক্যাল বোসন কণা মহাকর্ষ বলের বাহক হতে পারে, যার স্পিন ২। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এ কণার অস্তিত্ব পরীক্ষায় ধরা পড়েনি।

তারপরও, স্ট্যান্ডার্ড মডেল একটি অসাধারণ সাফল্য। পদার্থের গঠন, বলের ব্যাখ্যা এবং কণাদের আচরণ বিশ্লেষণে এটি এখন বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মডেল। তাই একে মজা করে বিজ্ঞানীরা বলেন, “থিওরি অফ অলমোস্ট এভরিথিং”।

তবে বিজ্ঞানের যাত্রাপথ শেষ হয় না কখনো। বছরখানেক আগে মিউওন সম্পর্কিত একটি পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরের একটি অজানা বলের ইঙ্গিত পেয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, এটি হতে পারে নতুন কোনো বল, যা আমাদের আজকের তত্ত্বকে পাল্টে দিতে পারে।  এই নুতন বলটির ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলার মত সময় হয়নি।তবে এ কথা ঠিক, নিত্যনুতন আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের বিকাশেরও কোনো সীমানা নেই। প্রকৃতির রহস্যভেদে মানুষের পথ চলা তাই অবিরাম।  

© তানভীর হোসেন 

ছবি: উইকিপিডিয়া

Comments