৮ এপ্রিল ২০২৫ ছিল পিটার হিগসের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছর এই দিনে তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু শান্ত ও নির্জন আর চিন্তায় ডুবে থাকা এই মানুষটি বিজ্ঞানের জগতে রেখে গেছেন এক অসামান্য পদচিহ্ন।
পিটার হিগস ছিলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের এক অনন্য নাম।একজন মানুষ যিনি নিজের কল্পনার জোরে খুঁজে পেয়েছিলেন মহাবিশ্বের গভীর এক গোপন রহস্যের সন্ধান। হিগস বোসনের কথা তিনি বলেছিলেন সেই ১৯৬৪ সালেই, যখন এই কণার অস্তিত্ব ছিল শুধুই কাগজে-কলমে, কোন পরীক্ষাগারে নয়।
তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের সন্তান। জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালে, নিউক্যাসলে। ছোটবেলায় শারীরিক অসুস্থতা, স্কুলে কিছুটা নিঃসঙ্গতা, এসব পেরিয়ে একা একাই তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজের চিন্তার জগত। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মায় স্কুলে থাকতে থাকতে, পল ডিরাকের কাজ সম্বন্ধে পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে এডিনবরায় শিক্ষকতা, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা আর নিঃসঙ্গ সাধনার জীবন।
১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন, তাত্ত্বিকভাবে সবল ও দুর্বল পারমাণবিক বল বহনকারী বোসনগুলোর ভর থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখা গেল, ডব্লিউ (W) এবং জেড (Z) নামের দুর্বল পারমাণবিক বলের বাহক কণাগুলোর বিশাল ভর রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব দূর করতে ১৯৬৪ সালে পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের ফ্রাঁসোয়া অ্যাংলেয়ার্ত একটি সম্ভাব্য সমাধান প্রস্তাব করেন। তাঁদের প্রস্তাব ছিল একটি অদৃশ্য ক্ষেত্র পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে বিদ্যমান। যার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে বস্তুকণাগুলো ভর অর্জন করতে পারে। পিটার হিগসের নাম অনুসারে এই ক্ষেত্রের নাম দেওয়া হলো, "হিগস ফিল্ড"। তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী সেই ক্ষেত্রের একটি বল বহনকারী কণা রয়েছে। প্রস্তাবিত কণাটির নাম দেয়া হলো, "হিগস বোসন"। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে এটি পরীক্ষামূলক প্রমাণের অপেক্ষায় ছিল। হিগস বোসনকে খুঁজে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব এক কাজ। কারণ এই কণা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। শুধুমাত্র এক ক্ষুদ্রতম মুহূর্তের জন্য অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে। তারপর তা অন্যান্য কণায় পরিণত হয়ে যায়।
অধরা হিগস বোসনকে খুঁজে পেতে
ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (CERN) বিজ্ঞানীরা তৈরি করলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল ও শক্তিশালী পার্টিকেল এক্সেলেটর, যার নাম লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বা এল এইচ সি। সুইজারল্যান্ডের জেনিভার কাছে এর অবস্থান। এল এইচ সি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিলো প্রায় নয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮ সালে এটি চালু হয়েছিলো।
২০১২ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা হিগস বোসন কণাটিকে বাস্তবে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। সেই দিন কান্না চেপে পিটার হিগস বসেছিলেন দর্শকসারিতে। হিগস বোসন আবিষ্কার করার জন্য ২০১৩ সালে তাঁকে দেয়া হয় নোবেল পুরস্কার, ফ্রঁসোয়া অ্যাংলেয়ার্তের সাথে ভাগ করে।
কিন্তু নোবেল প্রাইজের খ্যাতি বা গ্ল্যামার তাঁকে কখনো টানেনি। তিনি থাকতেন খ্যাতির আড়ালে। সাধারণত কোনো মিডিয়াকে সাক্ষাৎকারে দিতেন না। নিজের গবেষণার পাদপ্রদীপের আলোয় একাই থাকতেন। পিটার হিগস ছিলেন আপাদমস্তক একজন বিজ্ঞানী। যিনি বিজ্ঞানের জন্যই বিজ্ঞানের সাধনা করতেন। নাম, খ্যাতি, পুরস্কার—এসব তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল না। এমনকি তিনি বলতেন, আজকের দিনে যদি একাডেমিয়ায় ঢুকতে যেতেন, তাহলে কেউ তাকে চাকরি দিত না। তাঁর গবেষণা কেউ পছন্দ করত না, কারণ সেটা ছিল "ট্রেন্ড” এর বাইরে।
পিটার হিগস আমাদের শিখিয়ে গেলেন, কখনো কখনো নিঃশব্দ চিন্তাও বদলে দিতে পারে পুরো পৃথিবীকে। বিজ্ঞানের জগতে তিনি ছিলেন একজন নিঃসঙ্গ শেরপা।তাঁর বিদায় পদার্থবিজ্ঞান জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু হিগস ফিল্ড, হিগস বোসন, আর তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তার রেশ থাকবে আমাদের মাঝে - এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণায়, প্রতিটি মূহূর্তে।
বস্তুর ভরের অনন্য ব্যাখ্যাকার, পিটার হিগসের মৃত্যুবার্ষিকীতে, তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
Comments