একটি বিশাল শহরের কথা চিন্তা করুন। সারা শহর জুড়ে অনেক কাজকর্ম একসাথে চলছে। রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে, গাড়িঘোড়া চলছে, মানুষজন অফিসে যাচ্ছে, ব্যাংকে যাচ্ছে, বাজার করছে, স্কুল কলেজে যাচ্ছে। সবাই যে যার মত ছুটছে। কিন্তু শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যদি কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে একসময় পুরো শহরটাই অচল হয়ে যাবে। এবার ভাবুন আমাদের শরীরের কথা। আমাদের শরীরও এক বিশাল শহরের মতো, যেখানে লক্ষ লক্ষ কোষ একসঙ্গে কাজ করছে। আর এই কোষগুলোর কাজ ঠিকঠাকভাবে চালানোর জন্য দরকার একদল দক্ষ ‘নিয়ন্ত্রক'। আর এরাই হচ্ছে স্মল আরএনএ, সংক্ষেপে এদের বলা হয় sRNA।
আমরা জানি, DNA আমাদের শরীরের জেনেটিক ব্লুপ্রিন্ট বহন করে, আর মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) সেই নির্দেশনা নিয়ে প্রোটিন তৈরি করে। কিন্তু sRNA নিজে কোনো প্রোটিন তৈরি করে না; বরং এটি ঠিক করে দেয়, কোন জিন কখন কাজ করবে, কতক্ষণ কাজ করবে, আর কখন থামবে। এক কথায়, sRNA হলো জীবকোষের ‘মাস্টার কন্ট্রোলার’।
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, sRNA অণুগুলো সাইজে ছোট। সাধারণত এগুলোর দৈর্ঘ্য ২০-৩০ নিউক্লিওটাইডের বেশি হয় না। ছোট হলে কি হবে, এরা কিন্তু খুবই ক্ষমতাবান। জীবকোষের ভেতরে এদের প্রভাব ব্যাপক। আগেই বলেছি, sRNA কোন প্রোটিন তৈরি করে না, কিন্তু বিশেষ কৌশলে কিছু জিনের কার্যকারিতা এরা কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে দেয়। একে বলা হয় আরএনএ সাইলেন্সিং (RNA Silencing)।
মনে করুন, আপনার শরীরের কোষে কোনো জিন খুব বেশি সক্রিয় হয়ে গেছে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রোটিন তৈরি করছে, যা আপনার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তখন sRNA এসে বলে, "আরে বাবা, এবার একটু থামো! এত বেশি প্রোটিনের দরকার নেই!" এরপর sRNA সেই নির্দিষ্ট জিনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যাতে প্রোটিন তৈরি হওয়া বন্ধ হয়। ঠিক যেমন, ট্রাফিক পুলিশ অতিরিক্ত গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে, sRNA জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে।
বিজ্ঞানীরা জীবকোষে বিভিন্ন ধরনের sRNA শনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে দু'টো প্রধান sRNA এর কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। এগুলো হলো:
• স্মল ইন্টারফেরিং আরএনএ (siRNA) – এটি সাধারণত বাইরের উৎস (ভাইরাস) থেকে আসে এবং সংক্রমিত কোষের আরএনএ নষ্ট করতে পারে। siRNA সংক্রান্ত গবেষণার জন্য অ্যান্ড্রু ফায়ার এবং ক্রেইগ মেলো নামে দুজন বিজ্ঞানী ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
• মাইক্রোআরএনএ (miRNA) – এটা শরীরের ভেতরেই তৈরি হয় এবং বিভিন্ন জিনকে নিয়ন্ত্রণ করে। miRNA আবিষ্কার করার জন্য ভিক্টর অ্যামব্রোস এবং গ্যারি রুভকুন নামে দুজন বিজ্ঞানী যৌথভাবে ২০২৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
জীবকোষের ভেতরে sRNA একটি বিশেষ কমপ্লেক্স তৈরি করে, যার নাম RISC (RNA-inducing silencing complex)। এটি একটি প্রোটিন-আরএনএ মিশ্রণ যা নির্দিষ্ট মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) কে শনাক্ত করে সেটাকে ধ্বংস করে, অথবা তার কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ফলে সেই নির্দিষ্ট জিন থেকে প্রোটিন তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা sRNA নিয়ে খুবই আগ্রহী, কারণ এটি দিয়ে ক্যান্সার সহ অনেক জটিল রোগের সমাধান করা যেতে পারে। এ নিয়ে সংক্ষেপে একটু আলোচনা করছি:
শরীরের কোথাও ক্যান্সার হলে, সেখানকার কোষ অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হতে থাকে। প্রাকৃতিক ভাবে কিছু miRNA এই বিভাজনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যখন তারা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তখন ক্যান্সার কোষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা এখন বিশেষ ধরনের siRNA তৈরি করছেন, যা ক্যান্সার কোষকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে।
অন্যদিকে, ভাইরাস যখন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তখন তারা নিজেদের আরএনএ ব্যবহার করে নতুন ভাইরাস তৈরি করতে থাকে। কিন্তু siRNA সেই ভাইরাল আরএনএ চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে পারে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে siRNA ব্যবহার করে নতুন চিকিৎসার পথ খুলে যাচ্ছে।
অ্যালঝাইমার বা পারকিনসনের মতো রোগে মস্তিষ্কে ক্ষতিকর প্রোটিন জমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু miRNA এই ক্ষতিকর প্রোটিনের উৎপাদন কমাতে পারে। ভবিষ্যতে sRNA ভিত্তিক ওষুধ দিয়ে এই রোগগুলোর চিকিৎসা করা সম্ভব হতে পারে।
বর্তমান যুগে, sRNA হলো জীববিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার, যা আমাদের কোষের অভ্যন্তরের গভীর রহস্য উন্মোচন করছে। এটি শুধু জিন নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভবিষ্যতে জিন-সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে।
© তানভীর হোসেন
Comments