মহাবিশ্বের রহস্য জানার ইচ্ছে মানুষের চিরন্তন। সেই কৌতূহল থেকেই মানুষ নিত্যনতুন টেলিস্কোপ পাঠাচ্ছে মহাকাশে। মহাবিশ্বকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার আশায়। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ইউক্লিড টেলিস্কোপ সেই যাত্রারই একটা বড় মাইলফলক। মূলত, মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি নিয়ে গবেষণা করতেই এই টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে।
২০২৩ সালের ১লা জুলাই, স্পেসএক্স ফ্যালকন ৯ রকেটের সাহায্যে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস স্টেশন থেকে ইউক্লিড টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। বর্তমানে এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট-২ (L2)-তে অবস্থান করছে। এটি মহাকাশের একটি বিশেষ স্থান, যা এক ধরনের পার্কিং প্লেসের মতো। এখানে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার মহাকর্ষ বল এমনভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে যে, মহাকাশযানগুলো এখানে খুব স্থিতিশীলভাবে অবস্থান করতে পারে। ফলে, দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণের জন্য এটি একেবারে আদর্শ স্থান।
ইউক্লিড টেলিস্কোপের কাজ মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, এটি মহাবিশ্বের বৃহৎ গঠন বিন্যাস খুঁজে বের করবে। দ্বিতীয়ত, এটি ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি কীভাবে মহাবিশ্বের প্রসারণকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে গবেষণা করবে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমরা মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির মাত্র ৫ শতাংশ দেখতে পাই, আর বাকি ৯৫ শতাংশই হলো অজানা ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি। এই রহস্যময় ভর-শক্তি দেখা যায় না, স্পর্শও করা যায় না। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ইউক্লিডের মাধ্যমে তাঁরা এসব অদৃশ্য ভর-শক্তির প্রভাব আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন এবং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের বিবর্তনের ইতিহাস আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এই টেলিস্কোপে দুটি প্রধান যন্ত্র রয়েছে। প্রথমটি হলো, ভিজিবল ইন্সট্রুমেন্ট (VIS), যা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান আলোর ছবি তুলতে সক্ষম। দ্বিতীয়টি হলো নিয়ার ইনফ্রারেড স্পেক্টোমিটার এন্ড ফটোমিটার (NISP), যা ইনফ্রারেড আলো ব্যবহার করে গ্যালাক্সিগুলোর দূরত্ব নির্ণয় করবে।
অর্থাৎ, ইউক্লিড শুধু গ্যালাক্সির ছবি তুলবে না, বরং সেগুলো কত দূরে রয়েছে, কীভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ওপর কী প্রভাব ফেলছে—এসব তথ্যও দেবে।
আরেকটি চমৎকার ব্যাপার হলো, ইউক্লিড একসাথে ১৫,০০০ বর্গ-ডিগ্রি এলাকায় মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, যা পুরো মহাবিশ্বের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি! এত বিশাল এলাকায় ডেটা সংগ্রহ করা গেলে, মহাবিশ্বের বৃহৎ কাঠামো সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা অনেক পরিষ্কার হবে।
ইউক্লিড মূলত গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নামের এক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে কাজ করবে। মহাকাশে যখন একটি বিশাল গ্যালাক্সি বা ডার্ক ম্যাটারের ঝাঁক থাকে, তখন সেটি তার ঠিক পিছনে থাকা আলোর গতিপথকে বাঁকিয়ে দেয়। এই বাঁকা আলোর বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, কোথায় কোথায় ডার্ক ম্যাটার ছড়িয়ে আছে এবং কীভাবে এটি সাধারণ পদার্থকে প্রভাবিত করছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই পদ্ধতিতে মহাবিশ্বের অনেক অজানা তথ্য উঠে আসবে।
তবে শুধু ডার্ক ম্যাটার নয়, ইউক্লিড ডার্ক এনার্জি সম্পর্কেও তথ্য দেবে। আমরা জানি, মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী কারণে বা কীভাবে এটি হচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা এর পেছনে ডার্ক এনার্জির ভূমিকা রয়েছে। ইউক্লিড বিভিন্ন গ্যালাক্সির গতিবিধি ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে ডার্ক এনার্জির কার্যকারিতা বোঝার চেষ্টা করবে। যদি ডার্ক এনার্জি সত্যিই মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাহলে এই শক্তির পরিমাপ কেমন হতে পারে, সেটাও অনুমান করা সম্ভব হবে।
ইউক্লিড আগামী ছয় বছর ধরে কাজ করবে এবং বিশাল পরিমাণ ডেটা পাঠাবে পৃথিবীতে। এই ডেটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করবেন, ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি কিভাবে আমাদের মহাবিশ্বকে গঠন করেছে এবং এখনও কীভাবে সেটিকে পরিবর্তন করছে। ইউক্লিডের পাঠানো তথ্য বর্তমানে প্রচলিত স্ট্যান্ডার্ড মডেল অফ কসমোলজি বা ল্যামডা সিডিএম মডেলকে পরীক্ষা করার সুযোগ করে দেবে এবং হয়তো মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরো নতুন কোনো তত্ত্ব উঠে আসতে পারে।
এছাড়াও এটি নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাথে মিলে আরও গভীরভাবে মহাকাশ গবেষণার সুযোগ তৈরি করবে। কারণ দুইটি স্পেস টেলিস্কোপই মহাবিশ্বের প্রাথমিক যুগের অজানা তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে। সব মিলিয়ে, ইউক্লিড টেলিস্কোপের মিশন চেনা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে দিতে পারে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কীভাবে মহাবিশ্ব গড়ে উঠেছে, কীভাবে এটি প্রসারিত হচ্ছে, এবং এর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, সেই সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, কবে সেই নতুন আবিষ্কারগুলো আমাদের সামনে আসবে।
এখানে ইউক্লিড টেলিস্কোপের VIS ক্যামেরায় তোলা মহাকাশের কিছু ছবি শেয়ার করলাম।
ছবি কৃতজ্ঞতা: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।
Comments