জীবজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অণু হলো ডি অক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড, সংক্ষেপে বলে, ডিএনএ (DNA)। অনেকে একে বলেন, "দি মাস্টার মলিকিউল অফ লাইফ"। জীবনের ব্লু প্রিন্টকে ধারণ করে ডিএনএ অণু। এতে পরিবর্তন হলে জীবের বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হয়ে যায়। জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক হলো ডিএনএ। জীবকোষের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজমের মধ্যেই মূলত এর অবস্থান। ডিএনএ অণুগুলো বেশ বড়ো আকারের হয়। দুটো লম্বা সুতোর মতো পরস্পরকে এরা জড়িয়ে থাকে। তাদের এই জড়িয়ে থাকা কাঠামোটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন, ডিএনএ ডবল হিলিক্স। এই ডবল হিলিক্স কাঠামোটি তৈরী হয়েছে ডি অক্সি রাইবোস, ফসফেট এবং চার ধরণের নাইট্রোজেন বেইস দিয়ে।
ডিএনএর কাজ হলো জীব জগতের জেনেটিক কোডকে ধারণ এবং বহন করা। জেনেটিক কোডের বর্ণমালায় রয়েছে ডিএনএর চারটি নাইট্রোজেন বেইস, অ্যাডেনিন, থায়মিন, গুয়ানিন এবং সাইটোসিন। এদেরকে নামের চারটি আদ্যক্ষর (ATGC) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ডিএনএ অণুর ভেতর A জোড় বেঁধে থাকে T এর সাথে, আর C জোড় বেঁধে থাকে G এর সাথে। এই চারটি মাত্র "অক্ষরের" সামগ্রিক বিন্যাসে এককোষী ব্যাকটেরিয়া সহ যাবতীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর জিনোম রচিত হয়েছে। জিনোম বলতে কোন জীবের সামগ্রিক ডিএনএ বিন্যাসকে বোঝায়।
কিন্তু জিন বলতে জিনোমের সেই সব অংশকেই বোঝায় যা নির্দিষ্ট কোন প্রোটিন তৈরীর কোডকে ধারণ করে। জীবের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য এবং ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে জিন। জিনোমের বেশির ভাগ অংশই হলো কোডবিহীন ডিএনএ। জিনগুলোকে জিনোমের ভেতর থেকে রীতিমতো খুঁজে বের করতে হয়। আর এই খুঁজে বের করার কাজটি বেশ কঠিন। মানুষের জিনোমের তিন বিলিয়ন বেইস জোড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেছে মাত্র কুড়ি হাজারের মতো জিন। এই জিনগুলো সম্মিলিত ভাবে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে।
সামগ্রিকভাবে জিনোম হচ্ছে একটি বিশাল বইয়ের মত। সমগ্র মানব জিনোমকে যদি বই আকারে প্রকাশ করা হয়, তাহলে সেই বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা হবে প্রায় ১১ লক্ষ। কিন্তু এই বইয়ের সকল লেখাই অর্থবহ হবে না। এতে থাকবে শুধুমাত্র বিশ হাজারের মতো অর্থবহ লেখা। এই অর্থবহ লেখাগুলোই হচ্ছে জিন, যা মানুষের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে নির্ধারণ করে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, এসব লেখার নিচে কিছু কিছু ফুটনোট রয়েছে। এইসব ফুটনোটে বলা আছে, লেখাটি কখন কিভাবে পড়তে হবে। এই ফুটনোটগুলোর জন্য মূল লেখার পড়ার ধরন কিছুটা বদলে যেতে পারে। এপিজেনেটিক পরিবর্তন ঠিক এইভাবেই কাজ করে।
এপিজেনেটিক পরিবর্তন ডিএনএ কোড বদলায় না, কিন্তু বাইরে থেকে জিনগুলোর কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা জানি, আমাদের শরীরে নানা ধরনের কোষ আছে। যেমন ত্বকের কোষ, স্নায়ুকোষ, যকৃৎ কোষ ইত্যাদি। প্রতিটি কোষের ডিএনএ কোড এক হলেও তারা একেকভাবে কাজ করে। কারণ প্রত্যেক কোষে নির্দিষ্ট কিছু জিন সক্রিয় থাকে, আর কিছু জিন নিষ্ক্রিয় থাকে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, জীবকোষের ভেতরে ডিএনএ অণুকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু কিছু ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া রয়েছে। জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের পেছনে এসব প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আসলে জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিএনএ শেষ কথা নয়। এর আড়ালেও কিছু কথা আছে। আর এটাই হলো, এপিজেনেটিক্সের মোদ্দাকথা।
আগেই উল্লেখ্য করেছি যে, ডিএনএ অণুগুলো দুটো লম্বা সুতার মতন পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে, যাকে বলে, ডিএনএ ডবল হিলিক্স। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায় ডিএনএ ডবল হিলিক্সের সাথে সংযুক্ত রয়েছে এক ধরনের প্রোটিন অণু, যার নাম হলো হিস্টোন। এই হিস্টোনকে ঘিরে ডিএনএ অণু পেঁচিয়ে থাকে ক্রোমোজোমের ভেতর। ডিএনএ এবং হিস্টোনের যৌথ কাঠামোটিকে বলে ক্রোমাটিন। এর ভেতরে ডিএনএ অণু আটটি হিস্টোন প্রোটিনকে ঘিরে একটি কমপ্লেক্স কাঠামো গঠন করে, এর নাম নিউক্লিওজোম। এই নিউক্লিওজোম কাঠামোটি ক্রোমাটিনের ভেতর কোন কোন স্থানে খুবই কোঁকড়ানো অবস্থায় থাকে, আর কোন কোন জায়গায় থাকে খোলা অবস্থানে। জিনের বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে নিউক্লিওজোম কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
নিউক্লিওজোমের খোলা অংশের ভেতর অবস্থিত জিনগুলো সংগত কারণেই সহজে প্রকাশ পায়। কিন্তু কোঁকড়ানো অবস্থানে থাকা জিনগুলো থাকে নিষ্ক্রিয়। নিউক্লিওজোমের ভেতর এদের দুর্গম অবস্থানের কারণে প্রোটিন তৈরির এনজাইমগুলো ঐসব জিনের নাগাল পায় না। সহজ কথায় বলা যায়, নিউক্লিওজোমের হিস্টোন প্রোটিনগুলো ডিএনএর বাইরে থেকেও জিন রেগুলেশনে উল্লেখযোগ্য এপিজেনেটিক ভূমিকা পালন করে। সাধারণভাবে বলা যায়, নিউক্লিওজোমের হিস্টোন প্রোটিনগুলোর কোন রকম পরিবর্তন হলে সেটা জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়াও ডিএনএর ভেতর রাসায়নিক পরিবর্তনও হতে পারে। অনেক সময় ডিএনএর সাইটোসিন (C) বেইসের সাথে একটি মিথাইল গ্রুপ (-CH3) সংযুক্ত হয়ে যেতে পারে। এর নাম হলো ডিএনএ মিথাইলেশন। কোন জিনের প্রোমোটার অঞ্চলে যদি ডিএনএ মিথাইলেশনহয় তাহলে ওই জিনের বহিঃপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। জিনোম জুড়ে অনেক স্থানেই ডিএনএ মিথাইলেশন দেখা যায়। এটিও জিন রেগুলেশনে গুরুত্বপূর্ণ এপিজেনেটিক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, নন-কোডিং আরএনএ নামের এক ধরনের অণু রয়েছে, যা এপিজেনেটিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এটি কিছু নির্দিষ্ট জিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে বা বাড়িয়ে দিতে পারে।
এপিজেনেটিক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের জীবনধারা ও পরিবেশ জিনের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। আমরা কী খাচ্ছি, কতটা ব্যায়াম করছি, আমাদের মানসিক চাপ কতটুকু, এমনকি আমাদের শৈশবে আমরা কী ধরনের পরিবেশে বড় হয়েছি— সবকিছুই এপিজেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের জিনের কার্যকলাপের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ধরা যাক, একজোড়া যমজ শিশু, যাদের জিন বিন্যাস হুবহু একই। যদি তাদের মধ্যে একজন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করে এবং ব্যায়াম করে, আর অন্যজন ধূমপান ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আসক্ত হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তাদের জিনের কার্যকলাপে পার্থক্য দেখা যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, এমনকি সামাজিক সম্পর্কও আমাদের জিনের কার্যকারিতার ওপর ছাপ ফেলে।
এপিজেনেটিক পরিবর্তন শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি পরবর্তী প্রজন্মেও প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী মায়ের খাদ্যাভ্যাস, মানসিক অবস্থা, এমনকি তার শরীরে থাকা বিষাক্ত পদার্থ শিশুর জিনের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডাচ হাঙ্গার উইন্টার নামে এক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, যেখানে মায়েরা অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, সেই সময়ে গর্ভে থাকা শিশুদের পরবর্তী জীবনে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও স্থূলতার ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিল, কারণ তাদের জিনের কিছু অংশ এপিজেনেটিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল।
সাধারনত নতুন কোন ভ্রুণ সৃষ্টির সময় আগের প্রজন্মের এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলো মুছে যায় এবং ভ্রুণটি নতুন করে আবার যাত্রা শুরু করে। একে বিজ্ঞানীরা বলেন, ভ্রূণের রি- প্রোগ্রামিং। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে ভ্রূণের রি- প্রোগ্রামিং সফল হলেও, একভাগ ক্ষেত্রে সফল নাও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আগের প্রজন্মের এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলো পরবর্তী প্রজন্মেও প্রকাশিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন, ইমপ্রিন্টিং। বংশগতির ধারা ডিএনএর আড়ালেও কাজ করতে পারে, এটাই এপিজেনেটিক্সের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
মানুষের কিছু বিরল রোগ রয়েছে যেগুলো এই এপিজেনেটিক প্রক্রিয়ায় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে যেতে পারে। তাছাড়া বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ক্যান্সার কোষের জিনগুলোতে সাধারণ কোষের তুলনায় ব্যাপক এপিজেনেটিক পরিবর্তন দেখা যায়। এ কারণে বিজ্ঞানীরা এপিজেনেটিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন, যা নির্দিষ্টভাবে ক্যান্সার কোষের জিনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে। অন্যদিকে ডিপ্রেশন, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ইত্যাদি মানসিক রোগের সাথেও এপিজেনেটিক পরিবর্তনের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে এপিজেনেটিক থেরাপি মানসিক রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পার্সোনালাইজড মেডিসিন বা ব্যক্তিগত চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এপিজেনেটিক্স গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু প্রতিটি মানুষের জিনগত ও এপিজেনেটিক প্রোফাইল আলাদা, তাই ভবিষ্যতে ডাক্তাররা নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য আলাদা ওষুধ ও চিকিৎসা নির্ধারণ করতে পারবেন।
বর্তমান যুগের উদ্ভিদ প্রজননবিদরা এপিজেনেটিক পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে নুতন জাতের ফসল উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা দেখেছেন, ধান, গম, ভুট্টা, সয়াবিন, বার্লি, ক্যানোলা, টমেটো ইত্যাদি ফসল যখন খরা, লবণাক্ততা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয় তখন এসব উদ্ভিদের মধ্যে ডিএনএ মিথাইলেশন সহ নানা ধরনের এপিজেনেটিক পরিবর্তন দেখা যায়। প্রতিকূল অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যই এসব পরিবর্তন ঘটে। তবে এই পরিবর্তনগুলো স্থায়ী নয়। এসব পরিবর্তনকে উদ্ভিদ প্রজননে কাজে লাগিয়ে ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তবে অসম্ভব নয়। সম্প্রতি এ ব্যাপারে সয়বিন, টমেটো এবং ক্যানোলার ক্ষেত্রে কিছু প্রাথমিক সাফল্য পাওয়া গেছে। এ নিয়ে এখন নিত্য নতুন গবেষণা হচ্ছে। প্রতিকূল আবহাওয়া সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনে এসব গবেষণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে এসব এপিজেনেটিক গবেষণা দিনদিন জোরদার হচ্ছে।
এপিজেনেটিক্স প্রমাণ করেছে, আমাদের জীবনধারা, অভ্যাস, পরিবেশ, এর সবকিছুই আমাদের জিনের কার্যকারিতা বদলাতে পারে। এটি আমাদের জন্য এক বিশাল সুযোগ। কারণ এর মানে হলো, আমরা স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারি। শুধু তাই নয়, আমাদের জীবনধারার ভালো বা খারাপ প্রভাব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও বহন করতে হতে পারে। এটাই হলো এপিজেনেটিক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
© তানভীর হোসেন
Comments