প্রজাপতির পাখা


মনে করুন, ব্রাজিলের উপকূলে হালকা হাওয়ায় একটি প্রজাপতি পাখা ঝাপটালো। আর সেই হাওয়ার কাঁপন ক'দিন পরেই হাজার মাইল দূরে টেক্সাসে গিয়ে ভয়ানক এক টর্নেডো হয়ে দেখা দিল। কি অদ্ভুত কথা, তাই না? কিন্তু এই অদ্ভুত চিন্তাটার পেছনে রয়েছে গভীর এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, যার নাম "বাটারফ্লাই ইফেক্ট"।

গল্পটার শুরু ১৯৬৩ সালে। আবহাওয়া বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড লরেঞ্জ একদিন একটি ক্লাইমেট মডেলিং করছিলেন। এই মডেল দিয়ে বোঝা যেত কিছুদিন পর বৃষ্টি হবে না রোদ থাকবে। কিন্তু সেদিন তিনি ছোট্ট একটি ভুল করে ফেললেন। একটি ছয় দশমিকের সংখ্যার তিন দশমিকের পরের ঘরগুলো বাদ দিয়ে, সংখ্যাটা সামান্য একটু কমিয়ে মডেলে ইনপুট দিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এতটুকু সামান্য রাউন্ডিং করলে কিছুই এসে যায় না। কিন্তু মডেলিংয়ের ফলাফল দেখে তিনি তো হতবাক। সংখ্যাটি সামান্য বদলালেও  ফলাফলের চিত্রটি  পুরোপুরিই পাল্টে গেছে। এই ঘটনা থেকে লরেঞ্জ বুঝলেন, কোনো সিস্টেম যদি খুব সংবেদনশীল হয়, তাহলে অতি সামান্য পরিবর্তনও দূরে গিয়ে বিশাল পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে। এই ধারণাটাকেই বলা হয়, বিশৃঙ্খলার তত্ত্ব বা ক্যাওস থিওরি (Chaos Theory) আর তার মিষ্টি নাম  হচ্ছে, "বাটারফ্লাই ইফেক্ট"।

মজার ব্যাপার হলো, ক্যাওস থিওরির সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রাফিকস, যার নাম ‌"লরেঞ্জ  অ্যাট্রাক্টর", দেখতে অনেকটাই প্রজাপতির মতোই লাগে। এটি মূলত তিনটি ডিফারেনশিয়াল সমীকরণের মাধ্যমে আঁকা একটা থ্রিডি গ্রাফ। কিন্তু যখন সেই সমীকরণের মানগুলো সময়ের সাথে বদলাতে থাকে, তখন গ্রাফটা একটি ঘূর্ণায়মান, ডাবল-লুপ আকৃতি নেয়। দেখলে মনে হয়, ঠিক যেন একটি প্রজাপতি দুটো পাখা ছড়িয়ে আছে। এই "প্রজাপতি-আকৃতি" কোনো এলোমেলো কল্পনা নয়, বরং একটুখানি পার্থক্য ভবিষ্যতে বিশাল ফারাক তৈরি করতে পারে, তার এক জলন্ত গাণিতিক প্রমাণ।

এই চিন্তা শুধু আবহাওয়ার ক্ষেত্রেই নয়, আরও অনেক জায়গায় কাজ করে। জলবায়ুর পরিবর্তন, অর্থনীতির উত্থান-পতন, মস্তিষ্কের ভাবনা, এমনকি আমাদের জীবনের ছোটখাট সিদ্ধান্তেও এর দেখা মেলে। ধরুন কাউকে একদিন হাসিমুখে “কেমন আছো” বলে ফেললেন। সেটা হয়তো সেদিন তার মনটা ভালো করে দিল। সে আবার ভালো একটি কাজ করলো, কারো সাহায্যে গিয়ে দাঁড়াল, আর সেই ভালোটা ছড়িয়ে গেল অনেক দূর পর্যন্ত। আপনি জানতেও পারলেন না, আপনার হাসিমুখের ছোট্ট কথাটাই বহু গুণে বেড়ে গিয়ে ভালো কোন ঢেউ তুলল পৃথিবীর অন্য কোথাও।

আমাদের এই পৃথিবীটা খুবই সূক্ষ্ম এক ছন্দে বাঁধা। যেখানে একটুখানি হাওয়াও বদলে দিতে পারে অনেক কিছু। লরেঞ্জ আমাদের সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এই যে আমরা বলি, “এতটুকু ব্যাপার তো কিছুই না"। এই “তুচ্ছ” ব্যাপারটাই হয়তো একদিন হয়ে উঠতে পারে সবকিছুর শুরু।

তাই জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকেও হালকা করে দেখা চলে না। কারণ, কে জানে একটি ছোট্ট কাজ, একটুখানি ভালোবাসা, বা নিঃশব্দ একটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়তো একদিন কারো জীবনে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এটাই বাটারফ্লাই ইফেক্ট। একটি প্রজাপতির পাখা থেকে বিশাল পৃথিবীর ছন্দ বদলে যাওয়ার গল্প।




Comments