বিজ্ঞানীরা এক আশ্চর্য ক্যামেরা তৈরি করেছেন, যার নাম LSST (Legacy Survey of Space and Time) ডিজিটাল ক্যামেরা। এটি শুধু বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা নয়, বরং এটি আগামী এক দশক ধরে মহাবিশ্বের গভীর রহস্য উন্মোচন করার এক মোক্ষম যন্ত্র।
এই ক্যামেরাটি এ বছর চিলির ভেরা সি রুবিন অবসার্ভেটরিতে স্থাপন করা হচ্ছে। এটি বিজ্ঞানীদের রাতের আকাশ বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করবে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এই একটিমাত্র ক্যামেরা প্রতি রাতে ৩০ টেরাবাইট ডেটা সংগ্রহ করতে পারবে। এর বিশাল সেন্সর, শক্তিশালী লেন্স এবং উন্নত প্রযুক্তি মহাবিশ্ব সম্পর্কে এমন সব তথ্য দেবে, যা আজ পর্যন্ত কেবল কল্পনার মধ্যেই ছিল। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, এই ক্যামেরা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৬৮ কোটি ডলার (১.৬৮ বিলিয়ন ডলার), যা বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
LSST ক্যামেরাটি আমাদের সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহাণু ও ধূমকেতুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, সুপারনোভা বিস্ফোরণ শনাক্ত করতে পারবে এবং এমনকি ব্ল্যাক হোলের আচরণও বুঝতে সাহায্য করবে। এই ক্যামেরার কাজ শুরু হবে ২০২৫ সালে, এবং এটি টানা ১০ বছর ধরে মহাবিশ্বের বিশদ পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাবে।
এই ক্যামেরার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো এর বিশাল সেন্সর। সাধারণত স্মার্টফোন ক্যামেরার রেজোলিউশন ১০০ মেগাপিক্সেলেরও কম হয়, সেখানে LSST ক্যামেরার সেন্সর ৩.২ গিগাপিক্সেল বা ৩২০০ মেগাপিক্সেল! এত বড় সেন্সরের মাধ্যমে এই ক্যামেরা রাতের আকাশের প্রতিটি কোণ বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। শুধু তাই নয়, এক ফ্রেমেই প্রায় ৪০টি পূর্ণ চাঁদের সমান আকাশের ছবি ধারণ করতে পারবে।
এটার লেন্সও একদম অদ্ভুত রকমের বড়। প্রধান লেন্সের ব্যাস ১.৫৭ মিটার, যা পৃথিবীর যেকোনো অপটিক্যাল ক্যামেরার মধ্যে সবচেয়ে বড়। তিনটি লেন্স মিলে এই ক্যামেরার অপটিক্যাল সিস্টেম তৈরি হয়েছে, যা দূরবর্তী মহাজাগতিক বস্তুদেরও অবিশ্বাস্য স্পষ্টভাবে দেখাতে সক্ষম। ফলে আমরা এমন কিছু নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির ছবি দেখতে পারব, যা আগে কখনোই এত স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব হয়নি।
আগেই বলেছি, এই ক্যামেরা প্রতি রাতে ৩০ টেরাবাইট ডেটা সংগ্রহ করবে। এত বিশাল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ করে এটি মহাবিশ্বের পরিবর্তনশীল বস্তুর পর্যবেক্ষণ চালাবে। এই ডেটাগুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, ডার্ক ম্যাটার, এমনকি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারবেন।
এটা সাধারণ কোন ক্যামেরা নয়, বরং এটা এক বিশাল যন্ত্র। এর ওজন প্রায় ৩ টন, যা একটি গাড়ির ওজনের কাছাকাছি। এর উচ্চতা ১.৬৫ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ৩ মিটার। এত বড় একটা ক্যামেরা যখন মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করবে, তখন সেটা আমাদের জন্য এক মহাজাগতিক জানালা খুলে দেবে।
LSST ক্যামেরার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্য উন্মোচন করা। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এর মাধ্যমে ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যাবে। এই ক্যামেরা আমাদের সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহাণু ও ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, যা পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক গ্রহাণুগুলোর গতিপথ বুঝতে সাহায্য করবে। এছাড়াও এটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করবে, যা মহাবিশ্বের বিবর্তন সম্পর্কে আরও গভীর অনুসন্ধান করবে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো, LSST ক্যামেরা মহাজাগতিক টাইম-ল্যাপস তৈরি করবে, যার মাধ্যমে মহাবিশ্ব কিভাবে সময়ের সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
এই বিশাল প্রজেক্ট, এবছর থেকে পূর্ণমাত্রায় কাজ শুরু করবে এবং পরবর্তী ১০ বছর ধরে প্রতিটি রাতের আকাশ বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এর মাধ্যমে যে পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ হবে, তা বিজ্ঞানীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই ক্যামেরা যে ডেটা সংগ্রহ করবে, তা বিশ্বের যেকোনো বিজ্ঞানী ব্যবহার করতে পারবেন, কারণ এটি ওপেন ডেটা পলিসি অনুসরণ করবে।
LSST ক্যামেরা শুধু একটি বিশাল ডিজিটাল ক্যামেরা নয়, বরং এটি মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার এক নতুন দুয়ার খুলে দেবে। এই ক্যামেরার সাহায্যে আমরা মহাবিশ্বের এমন কিছু বিষয় জানতে পারব, যা আজ অবধি শুধুই রহস্য ছিল। প্রতিটি রাতের আকাশ নতুন নতুন চমক নিয়ে আসবে, আর আমরা আরও গভীরভাবে বুঝতে পারব এই বিশাল মহাবিশ্বের অজানা দিকগুলো।
Comments