১৯০৫ সালের শুরুতে, প্যারিস শহরের এক কোণায় তাঁর ঘরে বসে ছিলেন, অঁরি পয়েনকেয়ার। একাধারে তিনি একজন বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। মাথায় তাঁর অগোছালো চুল, হাতে পেনসিল, আর চোখে দূরদর্শিতার ছোঁয়া। তিনি তখন নিমগ্ন হয়ে ভাবছেন সময় নিয়ে। না, কবিতার মতো ভাবনা নয়, একেবারে কঠিন বৈজ্ঞানিক নিয়মে। তিনি ভাবছিলেন, যদি আমি চলন্ত ট্রেনের ভেতর একটি
ঘটনা দেখি, আর অন্য কেউ সেই ট্রেনটা বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে দেখে, তাহলে আমাদের দু'জনের দেখার অভিজ্ঞতা কি একই রকম হবে?
এ প্রশ্নটা সহজ সরল মনে হলেও, সেটার ভিতরে ছিল ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের এক অজানা আবিষ্কার। সময় ও ঘটনার ধারনা তখন ছিল স্থির। ঘড়ি একই তালে সময় মাপে, এ ব্যাপারে সবাই ছিল একমত। কিন্তু পয়েনকেয়ার বললেন, “না, সময় সবার জন্য এক রকম নয়। সময় নির্ভর করে কে কোথায় দাঁড়িয়ে দেখছে, আর কী ভাবে মাপছে তার উপর।” তাঁর ভাষায়, সময় একটা সমঝোতা। দুই পর্যবেক্ষকের মধ্যে আলো পাঠিয়ে ও ফিরিয়ে এনে সময় হিসেব করে যে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, সেটাই সময়ের প্রকৃত পরিমাপ।
এই ভাবনাগুলো তিনি গুছিয়ে তুলছিলেন ধীরে ধীরে। ১৮৯৮ সালেই তাঁর লেখা "La mesure du temps" (সময়ের পরিমাপ) নামের প্রবন্ধে এইসব প্রশ্ন তিনি উত্থাপন করেছিলেন। তারপর ১৯০৪ সালে, আমেরিকায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “আমি বিশ্বাস করি, সব ভৌত নিয়ম সব পর্যবেক্ষকের জন্য একই হওয়া উচিত।” এই কথাটাই পরে হয়ে ওঠে আপেক্ষিকতার ভিত্তি।
এরপর ১৯০৫ সালে, জুন মাসে, তিনি এক বিশাল গবেষণাপত্র ছাপালেন—"Sur la dynamique de l’électron" (ইলেকট্রনের গতিশক্তি সম্পর্কে)। এই গবেষণাপত্রে ছিল গাণিতিক বিশ্লেষণ, লোরেঞ্জ রূপান্তরের বিশদ ব্যাখ্যা, সময়ের আপেক্ষিকতা, দৈর্ঘ্যের সংকোচন, এমনকি আলোর গতি নির্বিচারে একই, এই সব বৈজ্ঞানিক ধারণাও তিনি দিলেন। তবে তিনি কোথাও সাহস করে বলেননি, “এই হচ্ছে প্রকৃত সময় ও স্থান।” বরং বললেন, “এসব হচ্ছে সময় মাপার সুবিধার্থে তৈরি সমন্বয়।” তিনি তাঁর গবেষণাপত্রে ইথারের ধারণাটি ধরে রেখেছিলেন, যদিও তিনি জানতেন, হয়তো এর দরকার নেই।
এদিকে, সুইজারল্যান্ডের বার্ণ শহরের পেটেন্ট অফিসে তখন কাজ করছিলেন এক অখ্যাত তরুণ। বিজ্ঞানী মহলে তাঁকে তেমন কেউ চেনে না। তাঁর নাম, আলবার্ট আইনস্টাইন। পেটেন্ট অফিসে তাঁর কাজ ছিল নতুন যন্ত্রের নকশা যাচাই করা আর কাগজে সিল মারা। কিন্তু তাঁর মাথায় তখন খেলছিল অন্য চিন্তা। তিনি ভাবছিলেন, “আমি যদি আলোর গতিতে ছুটি, তাহলে আমার পাশাপাশি ছোটা আলোর রশ্মি কি থেমে যাবে?” কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়। কারণ ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন, আলো সব পরিস্থিতিতে একই গতিতে চলে। তাহলে সময় আর স্থান নিয়ে নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল আছে। হয় আলো ব্যতিক্রমী, নয়তো সময়-স্থান সম্পর্কে আমাদের চিরায়ত ধারণাই ভুল।
সেই ভুল ঠিক করতেই আইনস্টাইন ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করলেন তাঁর কালজয়ী গবেষণাপত্র—“Zur Elektrodynamik bewegter Körper”( চলমান বস্তুর ইলেক্ট্রো ডায়নামিকস বিষয়ে)। এটি ছিল আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বললেন, আলোর গতি সব ইনর্শিয়াল ফ্রেমে একই রকম, আর সময় ও স্থান আপেক্ষিক। তিনি ইথারকে এক লাইনেই বাতিল করে দিলেন, বললেন, “এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এটা শুধু একটা অপ্রয়োজনীয় ফিকশন।”
আইনস্টাইন সাহস করে বলেছিলেন, গতির সাথে সময় নিজেই বদলায়। চলমান বস্তুর গতি বৃদ্ধি পেলে তার জন্য সময় শ্লথ হয়ে যায় এবং দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়। কোন ঘটনা এক পর্যবেক্ষকের কাছে যখন ঘটে, অন্যের কাছে তা পরে বা আগে ঘটতে পারে। যে ধারণাকে পয়েনকেয়ার গাণিতিক পরিধির মধ্যে রেখেছিলেন, আইনস্টাইন সেটাকে বাস্তবতার নিরিখে ব্যাখ্যা করে মানুষের চিন্তার জগতে এক বিস্ফোরণ ঘটালেন।
আপেক্ষিকতা নিয়ে পয়েনকেয়ার তাঁর গবেষণা আইনস্টাইনের আগেই প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে কখনো দাবি করেননি যে, বিশেষ আপেক্ষিকতার পূর্ণ রূপ তিনি দিয়েছেন। তাছাড়া পয়েনকেয়ার ছিলেন বিনয়ী এবং ধীরস্থির। তিনি হয়তো চাইতেন সবদিক বিবেচনা করে তারপর কথা বলতে। হয়তো লোরেঞ্জ ও অন্যদের প্রতি সম্মান রেখে নিজেকে একটু আড়ালে রাখতেন। আর ঠিক তখনই তরুণ আইনস্টাইন তাঁর সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁর চোখে বিজ্ঞান ছিল একটা নির্ভীক অভিযান। শুধু গাণিতিক সমীকরণ নয়, সরল যুক্তি আর কল্পনার শক্তি দিয়ে একটা জগৎ বদলে দেওয়ার ডাক। এই কারণেই ইতিহাস পয়েনকেয়ারকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু আইনস্টাইনকে মনে রাখে। কারণ গল্পটা কে আগে বলল, সেটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, কে এমনভাবে বলল, যাতে পুরো পৃথিবী থমকে শুনল এবং বিশ্বাস করল।
পয়েনকেয়ার ছিলেন শান্ত ও স্পষ্ট, কিন্তু আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন তিনি। আর আইনস্টাইন ছিলেন বজ্রের মতো গতিশীল, তীব্র এক ঝলক। আপেক্ষিকতার দৃশ্যপটে তাঁর আবির্ভাব ছিল একেবারেই নাটকীয়। তবে যারা গল্পের গভীরে যেতে চান, তাঁরা বোঝেন, আপেক্ষিকতার এই দৌড়ে, প্রথম পা রেখেছিলেন পয়েনকেয়ারই। আইনস্টাইন সেই দৌড়টা শেষ করে বিশ্বকে একেবারে চমকে দিলেন। তিনি দেখালেন, সময় নিজেই ভেসে বেড়ায়। সময় ধ্রুব নয়, আপেক্ষিক।
আপেক্ষিকতা নিয়ে পয়েনকেয়ার এবং আইনস্টাইনের এই দৌড়ঝাঁপ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের কৃতিত্বও অনেক সময় আপেক্ষিক।
© তানভীর হোসেন
Comments