ভূমিকম্প: কতটা ঝুঁকির মধ্যে বাংলাদেশ?

গতকাল ২৮ মার্চ ২০২৫, মায়ানমারের মান্দালয় অঞ্চলে ৭.৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। কয়েক সেকেন্ডের ঝাঁকুনিতেই ধ্বসে পড়েছে অনেক ভবন, শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক। এর কম্পন অনুভূত হয়েছে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক পর্যন্ত।এমনকি আমাদের  বাংলাদেশেও এর কাঁপুনি টের পাওয়া গেছে। কিন্তু এই ঘটনাটি শুধু প্রতিবেশী দেশের সমস্যা হিসেবে দেখলে চলবে না, বরং আমাদের জন্য এটা একটি আগাম সতর্কবার্তা।

আমাদের পৃথিবীটা কিন্তু যেমনটা বাইরে থেকে দেখায়, তেমন শান্ত নয়। এর ভিতরে চলছে বিরামহীন এক টানাপোড়েন যেটা আমাদের চোখে পড়ে না। পৃথিবীর ভূত্বক অনেকটা ডিমের খোসার মতো, আর সেটা মোটেই অখন্ড নয়। বরং ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল সব টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো পৃথিবীর অভ্যন্তরের গলিত ম্যান্টলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে।  প্রতি বছরই এরা কয়েক মিলিমিটার করে সরে যায়। এই নড়াচড়ার সময় একটা প্লেট আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খায়, কেউ কারও নিচে ঢুকে পড়ে, কেউ আবার কিছুটা ফাঁক হয়ে যায় অথবা পাশ কাটিয়ে চলে। তখন ভূত্বকে সৃষ্টি হয় দারুণ চাপ। এই চাপ বহু বছর ধরে জমতে থাকে। একটা সময়ে ভূত্বক সেই চাপ আর সহ্য না করতে পেরে হঠাৎ ছেড়ে দেয়, তখনই ঘটে ভূমিকম্প। এই ঘটনার নাম, ইলাস্টিক রিবাউন্ড (elastic rebound), তার মানে ভূত্বক বাঁকিয়ে রাখা রাবার ব্যান্ডের মতো আচরণ করে, আর হঠাৎ করে ছেড়ে দেওয়া মাত্রই তা কেঁপে ওঠে।

ভূমিকম্প যখন ঘটে, তখন সেই কম্পন আসলে তিন ধরনের ভূ-তরঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায়। প্রথমে আসে পি-তরঙ্গ (P-wave), যেটা দ্রুত ছুটে আসে, কিন্তু তেমন ক্ষতি করে না। এরপর আসে এস-তরঙ্গ (S-wave), এটা একটু ধীরে আসে, কিন্তু এর কাঁপুনি অনেক বেশি বিধ্বংসী। সবশেষে আসে পৃষ্ঠ তরঙ্গ (surface wave), এটাই সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ এই তরঙ্গ ভূ-পৃষ্ঠ বরাবর ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িঘর, সেতু, রাস্তাঘাট সবকিছু কাঁপিয়ে তোলে। 

বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পীয় অঞ্চলের কাছাকাছি। তিনটি বড় বড় টেকটনিক প্লেট—ভারতীয়, ইউরেশীয় আর বার্মা মাইক্রোপ্লেট—এদের সংঘর্ষের জায়গা আমাদের দেশের একেবারে সীমানা ঘেঁষে। এই অঞ্চলে রয়েছে ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন, যেখানে ভারতীয় প্লেট ধীরে ধীরে বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকে পড়ছে। এই ‘সাবডাকশন’ প্রক্রিয়াটিই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎস।

২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের সুনামি সৃষ্টি করা ভূমিকম্পও এমনই একটি সাবডাকশন জোন থেকে শুরু হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি পর্যন্ত সামান্য বদলে গিয়েছিল। আমাদের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি এই সাবডাকশন জোনের কাছে অবস্থিত। তাই একটি বড় ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে, সেটা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেও স্পষ্ট হয়ে যায়, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের আতঙ্ক থেকে কখনোই মুক্ত ছিল না। ১৭৮৭ সালে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের মূল প্রবাহ স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হয়। এই ভূমিকম্পের আগে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ তিস্তা ও আত্রাই নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু ভূমিকম্পের অভিঘাতে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা ও ঢাল বদলে যায়, ফলে ব্রহ্মপুত্র তার পথ পরিবর্তন করে বর্তমানে যমুনা নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার নদীগত ইতিহাসে এক বিরল ভূমিকম্প-জনিত ঘটনাপ্রবাহ। ১৮৯৭ সালের মেঘালয় সীমান্তের ভূমিকম্পে ঢাকা শহর পর্যন্ত ভয়াবহ কাঁপুনি টের পেয়েছিল। ১৯৫০ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম-তিব্বত সীমান্তে সংঘটিত ৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্প ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বড়। এমনকি ১৯৯৭ সালে বান্দরবান অঞ্চলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে বহু ঘরবাড়ি ধসে পড়ে। ২০১১ সালে মিয়ানমার সীমান্তে ভূমিকম্পের কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে যথেষ্ট কাঁপুনি হয়েছিল।

ভূকম্পবিদরা আমাদের দেশের আশেপাশের কিছু কিছু অঞ্চলকে সিসমিক গ্যাপ (seismic gap) এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। অর্থাৎ বহু বছর ধরে সেখানে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি, তার ফলে ভূগর্ভস্থ শক্তি ক্রমাগত জমে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এটা অনেকটা এমন এক অবস্থা, যখন  বিশাল একটি পাত্রে পানি ঢালতে ঢালতে যখন কিনারা ছুঁই ছুঁই অবস্থা হয়, তখন মাত্র এক ফোঁটা অতিরিক্ত পানি পড়লেই তা উপচে পড়ে। এই উপচে পড়াটাই ভবিষ্যতের বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের এই অঞ্চলে বড় কোন ভূমিকম্প হওয়াটা এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনুযায়ী চারটি সিসমিক জোনে ভাগ করা হয়েছে। জোন-১ হলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, যেখানে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও আশপাশের কয়েকটি জেলা পড়ে। এখানে ভূমিকম্প হলে কাঁপুনির তীব্রতা সবচেয়ে বেশি হতে পারে, কারণ এই এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং অবস্থান খুবই সক্রিয় প্লেট সীমান্তের কাছে। এই অঞ্চলের কাছে ডাউকি ফল্ট নামে একটি সক্রিয় ভূ-গাঠনিক বিভাজন রেখা‌ রয়েছে, যা ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে প্রসারিত। এটি একটি থ্রাস্ট ফল্ট, যেখানে ভারতীয় প্লেট ইউরেশীয় প্লেটের নিচে চলে যাচ্ছে। এর ফলে এই অঞ্চলটি অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

জোন-২ ধরা হয় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু জেলা এই জোনের অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভূমিকম্পের প্রবণতা অনেক বেশি হলেও জোন-১ এর চেয়ে কিছুটা কম। এই অঞ্চলেও ভূমিকম্পের জন্য উচ্চমাত্রার সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। 

জোন-৩ হলো মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, যেখানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের মধ্যাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা রয়েছে। এই এলাকায় মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। তাই কিছুটা ঝুঁকি কম থাকলেও ভূমিকম্পের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি  থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঢাকা শহরের মাটি অনেক জায়গায় নরম, এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, এবং অনেক ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধীভাবে নির্মিত নয়। এখানে একটি মাঝারি আকারের ভূমিকম্পেও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ হলো জোন-৪, যেখানে পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যেমন খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ইত্যাদি জেলা। এই অঞ্চল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হলেও, ভূমিকম্পের আশঙ্কা একেবারে নেই, এমনটা বলা যায় না।

আমরা চাইলেই ভূমিকম্প ঠেকাতে পারি না। কিন্তু পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারি।  আমরা যদি আগে থেকেই সতর্ক হই, তাহলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব। সেই জন্য প্রয়োজন জন সচেতনতা‌ বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা এবং দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বাস্তবসম্মত প্রস্তুতি। আমাদের ঘরবাড়ি নির্মাণে এখন থেকেই ভূমিকম্প সহনীয় ডিজাইন অনুসরণ করা উচিত। স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প মহড়া চালু করা দরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেখাতে হবে, ভূমিকম্প হলে কীভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হয়। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই বিপদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

ভূমিকম্প শুধু অন্য কোনো দুর্দশাগ্রস্ত দেশের ঘটনা নয়, বরং আমাদের বাস্তব, অত্যন্ত সম্ভাব্য এক ভবিষ্যৎ। ২০২৫ সালের মায়ানমার ভূমিকম্প তারই বার্তা জানিয়েছে। এখন থেকেই যদি আমরা প্রস্তুত না হই—তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে, আর জনসংখ্যার কারণে সেটা হবে অনেক বেশি নির্মম, অনেক বেশি বেদনাদায়ক। ভূমিকম্পের জন্য জোর প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই সময়।

ম্যাপ কৃতজ্ঞতা: BNBC


Comments