মনে করুন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি বাইরে এসে দেখলেন, চারপাশের সবকিছু বদলে গেছে। রাস্তা দিয়ে ঢিমেতালে ঘোড়ার গাড়ি চলছে। ভিড়ভাট্টা নেই। একজন হকার হাঁক-ডাক করে পত্রিকা বিক্রি করছে। পত্রিকার শিরোনামে লেখা "ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি চূড়ান্ত"। আপনি বিস্মিত হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছেন, কোথাও কোন আধুনিক বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে না। মানুষ বুড়িগঙ্গার ঘাট থেকে কলসিতে পানি নিচ্ছে, আর রাস্তায় গুটি কয়েক রিকশা চলছে। আপনি মনে মনে ভাবছেন, এটা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি! কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন, আপনি চলে এসেছেন ১৯৪৭ সালের ঢাকা শহরে।
সিনেমায় তো আমরা এমনটাই দেখি! "ব্যাক টু দ্য ফিউচার", "ইন্টারস্টেলার" বা "দ্য টাইম মেশিন"— এসব কল্পকাহিনীতে মানুষ টাইম মেশিনে চড়ে অতীত আর ভবিষ্যতের দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বাস্তবে কি এটা সম্ভব? টাইম মেশিনের বাটন চাপ দিয়ে এক নিমেষে মুঘল আমলে বা ভবিষ্যতের কোন সময়ে গিয়ে হাজির হওয়া কি শুধুই গল্প? নাকি বিজ্ঞান সত্যিই কোনো একদিন এই অসম্ভবকে সম্ভব করবে? চলুন দেখে নেয়া যাক।
আমরা সবাই জানি, সময়ের স্রোত একদিকেই চলে। অতীত থেকে বর্তমান, আর বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে। নদীর স্রোতের মত সময়ের স্রোত এগিয়ে চলে সামনের দিকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সময় বিষয়টি এতটা সরল নয়! এর মাঝে আরো কিছু ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে।
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন
(১৯০৫) তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সময়ের সাথে গতির একটি সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, সময় ব্যাপারটি ধ্রুব নয়, এটি আপেক্ষিক। কোন বস্তুর গতি বৃদ্ধি পেলে তার জন্য সময়ের গতি কমে যায়। যেমন ধরুন, দুইজন জমজ ভাইয়ের একজনকে রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠানো হলো। আরেক ভাই পৃথিবীতেই অবস্থান করলো। ধরা যাক, মহাশূন্যে রকেটটি আলোর গতির কাছাকাছি (৯৯%) গতিতে পাঁচ বছর চলার পর পৃথিবীতে আবার ফিরে এলো। পৃথিবীতে ফিরে আসার পর দেখা যাবে ওই পাঁচ বছরে পৃথিবীতে ছত্রিশ বছরের সমান সময় পার হয়ে গেছে। এর কারণ হলো, আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে প্রচন্ড গতির কারণে রকেটের ভেতর সময়ের গতি কমে গিয়েছিলো। সেজন্য এক ভাইয়ের কাছে রকেটের ভেতর যে সময়কে মনে হয়েছে পাঁচ বছর, অন্য ভাইটির কাছে সে সময় পৃথিবীতে কেটেছে পুরো ছত্রিশ বছর। ভ্রমণ শেষে মহাশূন্যচারী ভাইটি তার পৃথিবীতে অবস্থানকারী জমজ ভাইটির চেয়ে বয়সে একত্রিশ বছর ছোট হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, সে ফিরে আসবে ছত্রিশ বছর পরের ভবিষ্যতে। তার চেনা পৃথিবী তখন অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। একে অনেকের কাছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে এটি সম্ভব। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় টাইম ডাইলেশন বা সময় প্রসারণ।
মজার ব্যাপার হলো, বাস্তবেও আমরা এখন টাইম ডাইলেশনের প্রয়োগ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে করছি। আজকাল গাড়িতে পথ নির্দেশনার জন্য জিপিএস (GPS) স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। এসব স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে কুড়ি হাজার কিলোমিটার উঁচুতে মহাশূন্যে অবস্থান করছে। এদের গতি আলোর গতির কাছাকাছি নয়, সেকেন্ডে মাত্র ৩.৯ কিলোমিটার। আলোর গতি হলো সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। সুতরাং এসব স্যাটেলাইটের গতি আলোর গতির একটি অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। কিন্তু তারপরও এই গতির কারণে জিপিএস স্যাটেলাইটের ঘড়িগুলো প্রতিদিন প্রায় ৭ মাইক্রো সেকেন্ড করে স্লো হয়ে যায়। এখানে অবশ্য আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে। সেটি হলো, সময়ের উপর মহাকর্ষ বলেরও প্রভাব রয়েছে। সেটা আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে দেখিয়েছেন। পৃথিবী থেকে অনেক উচ্চতায় থাকার ফলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব জিপিএস স্যাটেলাইটের উপর কিছুটা কম হয়। এর ফলে জিপিএস স্যাটেলাইটের ঘড়ি পৃথিবীর ঘড়ির চেয়ে প্রতিদিন ৪৫ মাইক্রো সেকেন্ড বেশি গতিতে চলে। গতি এবং মহাকর্ষ, এই দুই ধরনের টাইম ডাইলেশনের ফলে সামগ্রিকভাবে জিপিএসের ঘড়িগুলো পৃথিবীর ঘড়ির চেয়ে ৪৫ বিয়োগ ৭, অর্থাৎ ৩৮ মাইক্রো সেকেন্ড বেশি গতিতে চলে। মাইক্রো সেকেন্ড হলো এক সেকেন্ডের মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। আমাদের দৈনন্দিন সময়ের হিসেবে এটি খুব বেশি কিছু নয়। তবুও এর জন্য জিপিএস স্যাটেলাইটের ঘড়িগুলোকে পৃথিবীর ঘড়ির সাথে পর্যায়ক্রমে ক্যালিব্রেশন করা হয়। এটা না করা হলে, জিপিএস স্যাটেলাইটগুলোর নির্দেশনা প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার করে ভুল হতো অর্থাৎ জিপিএস তখন কোন কাজেই আসতো না।
টাইম ডাইলেশনের ব্যাপারটিকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যত থেকে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না, তাই না? কিন্তু সমস্যা হলো, আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলার মতো কোনো যানবাহন মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। সুতরাং তাত্ত্বিকভাবে ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব হলেও, বাস্তবে এখনো নয়।
কিন্তু অতীতে ফেরা? সেটা আরো বড় সমস্যা! বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতীতে ফিরে যাওয়ার উপায় একেবারেই নেই, এমনটা নয়। এর জন্য দরকার হবে, ওয়ার্মহোল।এখানে বলে রাখি, বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে এমন কিছু চমকপ্রদ বস্তুর সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ব্ল্যাকহোল। এটি এমন এক মহাজাগতিক বস্তু যার প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এর ভেতর থেকে আলোকরশ্মি সহ কোন ধরনের সিগন্যালই বের হতে পারে না। বিজ্ঞানীদের ধারণা ব্ল্যাকহোলের ভেতর স্পেস-টাইমের বক্রতাটি একটি অসীম সুড়ঙ্গের আকার ধারণ করেছে। শুধু তাই নয়, স্পেস-টাইমের এই সুড়ঙ্গ দিয়ে মহাবিশ্বে একটি ব্ল্যাকহোল অন্য একটি ব্ল্যাকহোলের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে। বাইরে থেকে মনে হবে ব্ল্যাকহোল দু'টো লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্পেস-টাইমের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে তারা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় রয়েছে। স্পেস-টাইমের ভেতরের এই অদৃশ্য সুড়ঙ্গই হচ্ছে, ওয়ার্মহোল।
ব্যাপারটা সাইন্স ফিকশনের মত মনে হলেও, ওয়ার্মহোলের ধারণাটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায়। আইনস্টাইন এবং তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানী ন্যাথান রোজেন ১৯৩৫ সালে লেখা এক গবেষণা নিবন্ধে এর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
সহজভাবে বললে, ওয়ার্মহোল হচ্ছে মহাবিশ্বের শর্টকাট রাস্তা। মহাবিশ্বকে এক খন্ড কাগজের মতো ভাবুন। আপনি যদি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে চান, তাহলে কাগজের ওপর দিয়ে সরলরেখায় যেতে হবে। কিন্তু যদি কাগজটাকে ভাঁজ করে দেন, তাহলে দুই বিন্দু একসঙ্গে লেগে যাবে, আর সরাসরি সেখানে যাওয়া সম্ভব হবে। এই ফাঁকটুকুই হলো ওয়ার্মহোল, যেখানে সময়ের নিয়ম বদলে যেতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে, যদি সত্যিকারের ওয়ার্মহোল তৈরি করা যায়, তাহলে সেটা ব্যবহার করে হয়তো অতীতেও যাওয়া সম্ভব হবে! তবে সমস্যা হলো, এখন পর্যন্ত কোনো ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি, আর এর ভেতর দিয়ে কিছু পাঠানোর মতো প্রযুক্তিও নেই।
তবে ওয়ার্মহোল ছাড়াও, অতীতে ভ্রমণ করা সম্ভব। ব্যাপারে ফ্র্যাঙ্ক টিপলার নামে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটি অভিনব পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন, অত্যন্ত ভারী কোন বস্তুকে যদি সিলিন্ডারের আকৃতি দেয়া যায় এবং সেটাকে যদি প্রচন্ড গতিতে ঘোরানো যায়, তাহলে ওই সিলিন্ডারের ভেতর একটি টাইম টানেল বা সময়-সুড়ঙ্গ সৃষ্টি হবে, যার ভেতর দিয়ে অতীতে ভ্রমণ করা সম্ভব হবে। তিনি গাণিতিক ভাবে তাঁর ধারণাটি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য, এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো প্রযুক্তিও মানুষের হাতে নেই। সেজন্য এটাকেও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতোই মনে হবে।
আরেকদল বিজ্ঞানী মনে করেন, গবেষণাগারে প্রচন্ড শক্তিশালী মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে, স্থান-কালের চাদরের মধ্যে কৃত্রিম সুড়ঙ্গ তৈরি করে তার ভেতর দিয়ে অতীতে ফিরে যাওয়া যাবে। তবে এতটা শক্তিশালী মহাকর্ষ বল সৃষ্টি করার মত প্রযুক্তি মানুষের হাতে এখনও নেই। তবে ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে বলে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন।
সময়ের মাঝে ভ্রমণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহলের সীমা নেই। সেটি মাঝে মাঝে বিজ্ঞানীদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কিছু প্যারাডক্সের কথাও বলেছেন। যেমন ধরুন, কেউ যদি অতীতে ফিরে গিয়ে তার নিজের দাদাকেই ভুল করে কোন দুর্ঘটনা বশত ছোট বয়সেই মেরে ফেলে, তাহলে কি হবে? তাহলে তো তার নিজের বাবারই জন্ম হবে না এবং ফলে তার নিজেরও জন্ম হবে না। তাহলে সে তার দাদাকে মারলো কিভাবে? টাইম ট্রাভেলের ক্ষেত্রে একে বলা হয়, গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। তারপর ধরুন, আমরা ভাবছি ভবিষ্যতের মানুষ টাইম ট্রাভেল করার মত প্রযুক্তি অর্জন করবে। তাহলে এতদিনে ভবিষ্যৎ থেকে বেশ কিছু মানুষের অতীতে, অর্থাৎ আমাদের বর্তমান সময়ে চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু তাদেরকে কোথাও তো দেখা যাচ্ছে না। সেজন্য অনেক বিজ্ঞানী বলেন, টাইম ট্রাভেল ব্যাপারটি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবে বেশ গোলমেলে।
সময় ভ্রমণের সম্ভাবনা আপাতত কেবল বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বিষয় হলেও, বিজ্ঞানীরা একে একেবারে উড়িয়ে দেননি। পদার্থবিদ এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক ড: মিচিও কাকুর মতে টাইম ট্রাভেলের ক্ষেত্রে প্রকৃতিগত কোনো বাঁধা নেই, এটি মূলত একটি ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যা।
এই সমস্যার সমাধান করার মতো প্রযুক্তি মানুষ এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। ভবিষ্যতে যদি আমরা মহাকর্ষ আর সময়ের রহস্য পুরোপুরি বুঝতে পারি, তাহলে হয়তো টাইম মেশিন বানানোও সম্ভব হবে! কিন্তু এখন পর্যন্ত, আমাদের প্রধান কাজ হবে বর্তমান সময়টাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা। কারণ টাইম মেশিন থাকুক বা না থাকুক, হারানো সময় তো আর ফিরে পাওয়া যায় না!
© তানভীর হোসেন
Comments