মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়: হিগস বোসন

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, পদার্থের মৌলিক বস্তুকণাগুলোর মধ্যে কিছু কণা বেশ ভারী, কিছু খুব কণা খুব হালকা, আবার কোনটার কোন ভরই নেই। এই রহস্যের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন বস্তুজগতের এক অনন্য কণা। তাঁরা বলেছেন, এই কণাটির সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলেই অন্যান্য বস্তুকণার ভরের (mass) সৃষ্টি হয়। এই মিথস্ক্রিয়া বেশি হলে বস্তুকণার ভর হয় বেশি, মিথস্ক্রিয়া কম হলে ভর হয় কম, আর একেবারেই মিথস্ক্রিয়া না হলে সেই কণা হয়  একদম ভর শূন্য। 

এই কণাটি যদি না থাকতো, তাহলে আমাদের মহাবিশ্বের চিত্রটি হত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন কোন বস্তুই গঠিত হতে পারত না। গ্রহ, নক্ষত্র,  গ্যালাক্সি এর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব তখন থাকত না। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এই কণার গুরুত্ব কেন এত বেশি।  এই কণাটির নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন, হিগস বোসন। রহস্যময় এই কণার সন্ধান পেতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। 

গত পঞ্চাশ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নানান তত্ত্ব ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা পদার্থের মৌলিক রূপটি কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। তাঁরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর ভিত্তি করে বস্তুকণার একটি "স্ট্যান্ডার্ড মডেল" দিয়েছেন। যা দিয়ে বস্তুকণার মূল চরিত্র, তথা পদার্থের স্বরূপ অনেকটাই ব্যাখ্যা করা যায়। 

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মহাবিশ্বের যাবতীয় পদার্থ মূলত দুই ধরনের বস্তুকণা দিয়ে গঠিত। এদের নাম হলো, কোয়ার্ক এবং লেপ্টন। সাধারণত কোয়ার্ক কণাগুলো লেপ্টন কণাগুলোর চেয়ে ভারী হয়ে থাকে। এদের দিয়েই বিশ্বের সকল দৃশ্যমান পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে। সবল ও দুর্বল পারমাণবিক ‌বল এবং তড়িৎ চুম্বকীয় বল; এই তিন ধরনের বলের মাধ্যমে মৌলিক বস্তুকণাগুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়ে পদার্থের সৃষ্টি করে। বল বহনকারী কণাগুলোর নাম দেয়া হয়েছে, বোসন। বাঙালি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম অনুসারে এই নামকরণ করা হয়েছে।

১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন, তাত্ত্বিকভাবে সবল ও দুর্বল পারমাণবিক বল বহনকারী বোসনগুলোর ভর থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখা গেল,  ডব্লিউ (W) এবং জেড (Z) নামের দুর্বল পারমাণবিক বলের বাহক কণাগুলোর বিশাল ভর রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব দূর করতে, ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের ফ্রাঁসোয়া অ্যাংলেয়ার্ট একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব প্রস্তাব করলেন। তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি অদৃশ্য ক্ষেত্র (field) পুরো মহাবিশ্ব জুড়েই বিদ্যমান। যার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে বস্তুকণাগুলো ভর অর্জন করতে পারে। পিটার হিগসের নাম অনুসারে এই ক্ষেত্রের নাম দেওয়া হলো, "হিগস ফিল্ড"। তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী সেই ক্ষেত্রের একটি বল বহনকারী কণা রয়েছে। প্রস্তাবিত কণাটির নাম দেয়া হলো, "হিগস বোসন"। হিগস বোসন হল একটি ক্ষণস্থায়ী কণা, যা কেবল তখনই তৈরি হয়, যখন সেই হিগস ক্ষেত্রটি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। হিগস বোসন নিজে হিগস ক্ষেত্র তৈরি করে না, বরং এটির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে হিগস ক্ষেত্র বাস্তবেই রয়েছে। পরবর্তীতে হিগস ও তাঁর সহকর্মীদের এই তত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে এটি পরীক্ষামূলক প্রমাণের অপেক্ষায় ছিল। হিগস বোসন হয়ে ওঠে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের শেষ অনাবিষ্কৃত মৌলিক কণা। 

কিন্তু হিগস বোসনকে খুঁজে পাওয়া এত সহজ ছিল না। কারণ এই কণা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। শুধুমাত্র এক ক্ষুদ্রতম মুহূর্তের জন্য অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে। তারপর তা অন্যান্য কণায় পরিণত হয়ে যায়। অধরা হিগস বোসনকে খুঁজে পেতে ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (CERN) বিজ্ঞানীরা তৈরি করলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল ও শক্তিশালী পার্টিকেল এক্সেলেটর, যার নাম লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বা এল এইচ সি। সুইজারল্যান্ডের জেনিভার কাছে এর অবস্থান। এল এইচ সি  নির্মাণে ব্যয় হয়েছিলো প্রায় নয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার।‌ ২০০৮ সালে এটি চালু করা হয়েছিলো। 

ভূপৃষ্ঠের ১০০ মিটার নিচে এল এইচ সির সাতাশ কিলোমিটার চক্রাকার টানেল রয়েছে । এর কিছুটা অংশ রয়েছে ফ্রান্সে আর কিছুটা অংশ রয়েছে সুইজারল্যান্ডের ভেতরে। এল এইচ সির সুদীর্ঘ টানেলের বিভিন্ন স্থানে বসানো রয়েছে নয় হাজারেরও বেশি সুপার কন্ডাক্টিং ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেট। এগুলোকে রাখা হয়েছে মাইনাস ২৭১.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, অর্থাৎ পরম শূন্যের খুব কাছাকাছি তাপমাত্রা। এইসব সুপার কন্ডাক্টিং ম্যাগনেটগুলো এল এইচ সির টানেলের ভেতরে অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। তার ভেতর দিয়ে প্রোটন কণাগুলোকে প্রচন্ড গতিতে
ত্বরান্বিত করা হয়। 

এভাবে এল এইচ সির অভ্যন্তরে খুবই উচ্চশক্তির পরমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষা চালানো হয়। ত্বরান্বিত প্রোটন কণাগুলোকে দুটি বিপরীত মুখী টিউব দিয়ে প্রবাহিত করে প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর প্রোটন কণাদের মধ্যে ঘটানো হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। ১৩ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্ট (TeV) শক্তির প্রচন্ড এই সংঘর্ষের ফলে প্রোটন কণাগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে তাদের আদি অবস্থায় ফিরে যায়। এটি হলো পদার্থের সেই পূর্বাবস্থা যেটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে বিদ্যমান ছিল। মোদ্দা কথা হলো, এল এইচ সির ভেতরে কৃত্রিমভাবে বিগ ব্যাংয়ের প্রাথমিক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়।

এল এইচ সির ভেতরে প্রোটন কণাদের প্রচন্ড সংঘর্ষের ফলে নানা ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা উৎপন্ন হয়। এসব কণাগুলো অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী হলেও এল এইচ সির অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের পার্টিকেল ডিটেকটরে সেগুলো ধরা পড়ে।

বিজ্ঞানীরা ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এল এইচ সির অভ্যন্তরে লক্ষ লক্ষ কণা সংঘর্ষ বিশ্লেষণ করেন। প্রতিটি সংঘর্ষে হিগস বোসন তৈরি হয়নি, কিন্তু কয়েকটি সংঘর্ষে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু সংকেত পান, যা হিগস বোসনের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়।

অবশেষে, ২০১২ সালের ৪ জুলাই, সার্ন গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন যে তারা একটি নতুন কণার সন্ধান পেয়েছেন, যার ভর প্রায় ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট (GeV)। পরীক্ষাগারে পাওয়া কণার বৈশিষ্ট্যগুলো যাচাই করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন—এটাই সেই বহু প্রতীক্ষিত হিগস বোসন!
এই ঘোষণা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত হয়ে ওঠে। পুরো বিশ্ব থেকে বিজ্ঞানীরা সার্নের ল্যাবে উপস্থিত হন, অনেকেই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেন। কারণ শেষ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এই হিগস বোসনের অস্তিত্ব সরাসরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী সফলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। হিগস বোসন আবিষ্কার হবার পরের বছর, ২০১৩ সালে পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাংলেয়ার্টকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই আবিষ্কারটি ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে সত্যিই এক বিশাল মাইলফলক। কারণ এটি মহাবিশ্বকে বোঝার জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিল। এর মাধ্যমে বস্তু কিভাবে ভরযুক্ত হয়, তার একটি গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।

হিগস বোসন কেবলমাত্র একটি কণা নয়, এটি মহাবিশ্বের গঠন বোঝার অন্যতম মূল চাবিকাঠি। এই কণাটির পরীক্ষামূলক অস্তিত্ব প্রমাণ করলো, হিগস ক্ষেত্র পুরো মহাবিশ্বে জুড়েই ছড়িয়ে আছে। হালকা কণাগুলো (যেমন ইলেকট্রন) এই ক্ষেত্রের সাথে কম প্রতিক্রিয়া করে, তাই এগুলো হালকা ভরের হয়। আবার ভারী কণাগুলো (যেমন টপ কোয়ার্ক) এই ক্ষেত্রের সাথে বেশি প্রতিক্রিয়া করে, তাই এদের ভর হয় বেশি। অন্যদিকে ফোটন (আলোক কণা) এই ক্ষেত্রের সাথে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া করে না, তাই এগুলো ভরহীন হয়ে থাকে।

এই আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞানীরা আরও গভীর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা জানতে চাইছেন, হিগস বোসনের সাথে কি ডার্ক ম্যাটারের কোনো সম্পর্ক আছে? কিংবা হিগস ক্ষেত্র কি মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ গঠনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে? 

এখন পর্যন্ত, বিজ্ঞানীরা জানেন যে হিগস বোসন স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সাথে মিলে যায়। তবে মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীর সত্য জানার জন্য আরও প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার আপগ্রেড করা হয়েছে।  ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী পার্টিক্যাল এক্সেলেটর তৈরি করার পরিকল্পনাও রয়েছে। আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে মহাবিশ্বের আরো অনেক নতুন বিস্ময় মানুষের কাছে ক্রমেই উন্মোচিত হবে।
© তানভীর হোসেন 


Comments