পৃথিবীর অন্তিম পরিণতি

আমাদের এই সুজলা সুফলা পৃথিবী মহাশূন্যে ভাসমান একটি গ্রহ। সৌরজগতের অন্যান্য সব গ্রহের মতই পৃথিবীও প্রতিনিয়ত সূর্যকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে। সূর্য থেকে দূরত্বের বিচারে পৃথিবীর অবস্থান তৃতীয়। কিন্তু এই গ্রহটি সৌরজগতের অন্যান্য সব গ্রহের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তার কারণ হলো, পৃথিবী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে। পৃথিবীতে পানির আধিক্য থাকায় দূর মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে ছোট্ট একটি হালকা নীলাভ বিন্দুর মতো দেখায়। এই ক্ষুদ্র বিন্দুটাই আমাদের প্রিয় বাসভূমি পৃথিবী। মহাবিশ্বে এর অবস্থান অতি নগণ্য। 

পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী এবং উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সূর্যের তাপের উপর নির্ভরশীল। জীবজগতের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির সরবরাহ করে সূর্য। সূর্য না থাকলে পৃথিবীতে কখনো প্রাণের উন্মেষ ঘটতো না। পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবী থেকে সূর্যের এই দূরত্ব জীবজগতের বিকাশের জন্য একদম যথাযথ। সূর্য থেকে পৃথিবীর সঠিক দূরত্বের কারণে এই গ্রহে জীবজগতের জন্য সহনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করছে। যেটা খুব বেশিও নয় আবার খুব কমও নয়। গল্পের সেই গোল্ডীলকের ভাষায়, বলা যায়, "জাস্ট রাইট"। সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে এরকম অবস্থা নেই।  এই তাপ সহনীয় অবস্থার ফলে, পৃথিবীতে জীবজগতের অনুকূলে প্রচুর পানি এবং অক্সিজেন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আর কতকাল পৃথিবীতে এই জাস্ট রাইট অবস্থা বজায় থাকবে?

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীর অন্তিম পরিণতি সূর্যের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সম্প্রতি এ ব্যাপারে নাসার বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তাঁরা হিসেব করে বের করেছেন, আগামী পাঁচ বিলিয়ন বছরের মধ্যে সূর্য তার হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ করে একটি বিশাল রেড জায়ান্ট বা লোহিত দানব নক্ষত্রে পরিণত হবে। সূর্যের আয়তন তখন এত বৃদ্ধি পাবে যে, সূর্যের পরিধি পৃথিবীর কক্ষপথকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

এখানে বলে রাখি, মহাবিশ্বে সমস্ত নক্ষত্রেরই একটি নির্দিষ্ট জীবনচক্র রয়েছে। সূর্যও এর ব্যতিক্রম নয়। মহাবিশ্বে নক্ষত্র সৃষ্টির মূলে রয়েছে মহাকর্ষ বল। মহাশূন্যে ভাসমান হাইড্রোজেন গ্যাস মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পুঞ্জিভূত হয়ে নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন পরমাণুর পরস্পরের সংঘর্ষের ফলে থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন (Fusion) প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ফলে হাইড্রোজেন পরমাণু হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তির উদ্ভব হয়। নক্ষত্রটি তখন প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এভাবেই একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়। এরপর নক্ষত্রটি জ্বলতে থাকে দীর্ঘদিন। এক সময় নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে থাকে। হিলিয়াম পরমাণুও আস্তে আস্তে আরো ভারী পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়। ‌ধীরে ধীরে নক্ষত্রের কেন্দ্রে আয়রনের মত ভারী পরমাণুর সৃষ্টি হয়। এই সময় নক্ষত্রটির আয়তন অনেক বৃদ্ধি পায়। তখন এটি একটি বিশাল লোহিত দানব‌  নক্ষত্রে পরিণত হয়। নক্ষত্রটি তখনও প্রজ্জ্বলিত থাকে। তারপর আস্তে আস্তে নক্ষত্রটির হাইড্রোজেন জ্বালানি আরো ফুরিয়ে যায়। তখন সেটা সংকুচিত হতে হতে একটি শ্বেত বামন (White Dwarf) নক্ষত্রে রূপান্তরিত হয়। শেষ পর্যন্ত সমস্ত জ্বালানি শেষ হয়ে এটি একটি কৃষ্ণ বামন  (Black Dwarf) নক্ষত্র হয়ে নিভে যায়। সাধারণত এভাবেই সূর্যের মতো সাইজের নক্ষত্রগুলোর জীবনাবসান হয়। 

সূর্যের বয়স এখন প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর। নক্ষত্রের বয়সের বিচারে সূর্যকে এখনো তরুণ বলা চলে। সূর্যের সম্পূর্ণভাবে লোহিত দানব নক্ষত্রে পরিণত হতে এখনো কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন বছর বাকি রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর উপর সূর্যের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া পাঁচ বিলিয়ন বছরের অনেক আগেই ঘটবে। এর ফলে পৃথিবীর জলবায়ু এবং পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। পৃথিবীর উপর সূর্যের এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবগুলো কয়েকটি গুরুতর ধাপের মধ্য দিয়ে যাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হবে, Moist Greenhouse Effect বা আর্দ্র গ্রীনহাউস প্রভাব। প্রাকৃতিক জীবনচক্রে সূর্যের আকার বৃদ্ধি হওয়া শুরু হলে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। এর ফলে মহাসাগর থেকে বিপুল পরিমাণ পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগকে অতিমাত্রায় জলীয় বাষ্পে পরিপূর্ণ করবে। জলীয় বাষ্পও কিন্তু কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতই এক ধরনের গ্রীন হাউস গ্যাস। বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে জলীয় বাষ্প বৃদ্ধি পেলে পৃথিবীর পৃষ্ঠে আরো বেশি মাত্রায় তাপ আটকে যাবে। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া বহুগুনে বেড়ে যাবে। একসময় এই তাপমাত্রা এমন এক অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যখন পৃথিবীতে কোন প্রাণী বা উদ্ভিদের পক্ষেই জীবনধারণ করা আর সম্ভব হবে না। আমাদের এই সুজলা সুফলা সজীব প্রিয় গ্রহটি তখন একটি নিষ্প্রাণ এবং বন্ধ্যা গ্রহে পরিণত হবে।
 
নাসার হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বের  জন্য এখনো প্রায় ১.৫ বিলিয়ন বছর সময় রয়েছে। এটি অনেক দীর্ঘ সময় মনে হতে পারে। কিন্তু মহাজাগতিক পরিমাপের ক্ষেত্রে এটি সামান্য সময়। একবার আর্দ্র গ্রীনহাউস প্রভাব শুরু হলে, পৃথিবীর পৃষ্ঠ এতটাই গরম হয়ে উঠবে যে সেখানে জীবনের অস্তিত্ব থাকা আর সম্ভব হবে না। মহাসাগরগুলো উবে যাবে, বায়ুমণ্ডল তার আর্দ্রতা হারাবে, এবং জীবনের শেষ অবশিষ্টাংশগুলি সূর্যের প্রচণ্ড তাপে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। এর চূড়ান্ত পর্যায়ে, পৃথিবী শুক্র গ্রহের মত প্রচন্ড উত্তপ্ত  হয়ে উঠবে। পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছাবে। সূর্য তখনো একটি লাল দানব নক্ষত্রে প্রসারিত হতে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত সম্ভবত পৃথিবীকে গ্রাস করে নিবে। যদি গ্রহটি কোনভাবে এই পরিণতি এড়িয়েও যায়, এটি হবে একটি নির্জীব, পুড়ে যাওয়া শিলাখণ্ড, যা একটি মৃতপ্রায় নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরবে। এভাবেই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই  পৃথিবীতে সকল জীবনের অবসান হবে একটি অনিবার্য ঘটনা।

Comments