আলো ও মহাকর্ষ


আলোক রশ্মি ফোটন কণা দিয়ে তৈরি। পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রন যখন শক্তি স্তর পরিবর্তন করে তখন গুচছ গুচ্ছ শক্তির আকারে ফোটন বেরিয়ে আসে। ফোটন একটি কোয়ান্টাম কণা, এর ভর হলো শূন্য, স্পিন হলো এক। এটি এক ধরনের বল বহনকারী কণা। এদের বলা হয় বোসন। 

ফোটনের কণা এবং তরঙ্গ ধর্ম দুটোই রয়েছে। ফোটন তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দৃশ্যমান আলো, ইনফ্রারেড রশ্মি, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি, এক্সরে, গামা রে, রেডিও ওয়েভ, মাইক্রোওয়েভ এ সবই হলো ফোটনের বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বহিঃপ্রকাশ। মহাবিশ্বে ফোটনের গতিই হলো সর্বোচ্চ। আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে দেখিয়েছেন, আলোর চেয়ে বেশি গতিতে কোন বস্তু চলতে পারে না। আলোর গতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। 

পরবর্তীতে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে  দেখিয়েছেন, স্থান-কালের বুননে বস্তুর উপস্থিতিতে এক ধরনের বক্রতার সৃষ্টি হয়। এই বক্রতাই হচ্ছে মহাকর্ষ বলের উৎস।  আইনস্টাইনের মতে, স্থান-কালের বুননে মহাকর্ষ একটি জ্যামিতিক ব্যাপার। ফোটনের উপরেও মহাকর্ষের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে নক্ষত্রের মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এর চারপাশে আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। মহাবিশ্বে এমন অনেক নক্ষত্র রয়েছে যাদের প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সব ধরণের আলোক রশ্মি বাঁধা পড়ে যায়। কোন আলোক রশ্মিই সে সব নক্ষত্র থেকে বের হতে পারে না। ফলে তারা হয়ে যায় অদৃশ্য। এসব অদৃশ্য নক্ষত্রের নাম ব্ল্যাকহোল। আমাদের চেনা মহাবিশ্বে অনেক ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পাওয়া গেছে। 

আলোর তরঙ্গের মতো মহাকর্ষও তরঙ্গের আকারে সারা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ‌১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সর্বপ্রথম মহাকর্ষ তরঙ্গের ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন মহাকর্ষ তরঙ্গ অত্যন্ত ক্ষীণ এবং দুর্বল। সেজন্য পৃথিবী থেকে একে শনাক্ত করাটা খুবই কঠিন। মহাকর্ষ তরঙ্গকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছে ঠিক একশ বছর। ২০১৫ সালে বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী পরীক্ষার মাধ্যমে মহাকর্ষ তরঙ্গকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আশ্চর্য ‌ব্যাপার হলো, মহাকর্ষ তরঙ্গের গতিও আলোর  গতির সমান। মহাবিশ্বে আলো ও মহাকর্ষ দুটোই দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে। 

আইনস্টাইন চেয়েছিলেন মহাকর্ষ এবং তড়িৎ চৌম্বকীয় বল, এ দুটো মৌলিক  বলের সমন্বয়ে একটি অভিন্ন ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি বা একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বের কাঠামো তৈরি করতে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সকল কার্যপ্রণালী একই সূত্রে গাঁথা। সুতরাং একটি সমীকরণের  মাধ্যমেই সেটা প্রকাশ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটি এত সহজ নয়। মহাকর্ষ এবং তড়িৎ চৌম্বকীয় বল, এ দুয়ের মাঝে যথেষ্ট বাহ্যিক পার্থক্য রয়েছে। আমরা জানি, মহাকর্ষ বল সবসময়ই আকর্ষণ ধর্মী। কিন্তু তড়িৎ চৌম্বকীয় বল আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ উভয় ধর্মী হতে পারে। তাছাড়া তড়িৎ চৌম্বকীয় বল, মহাকর্ষ বলের তুলনায় ১০^৩৬ গুন বেশি শক্তিশালী।  এ দুয়ের মাঝে সমন্বয় করা একটি দুরূহ ব্যাপার। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই কঠিন কাজটি করে যেতে পারেন নি। সেজন্য একে বলা হয়, আইনস্টাইনের অসমাপ্ত কাজ।

বর্তমান যুগের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাকর্ষের মূলে রয়েছে আরেক ধরনের বোসন কণা। যার ভর হলো শূন্য এবং কিন্তু স্পিন হলো দুই, অর্থাৎ ফোটনের দ্বিগুণ। এর নাম তাঁরা দিয়েছেন, গ্রাভিটন। অবশ্য এখনো পর্যন্ত গ্রাভিটন কণাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। এটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করাটা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। গ্রাভিটন কণা আবিষ্কার করা গেলে সেটি হবে পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি বিশাল মাইলস্টোন। এর মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের দুটো প্রধান স্তম্ভ কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এ দুয়ের মাঝে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হবে।

Comments