প্রকৃতির প্রতিশোধ

পঞ্চাশের দশকে  চীন দেশে চড়ুই পাখির খুব উৎপাত শুরু হয়েছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখির দল উড়ে এসে কৃষকের জমির পাকা ধান খেয়ে নিত। সে সময় চড়ুই পাখির অত্যাচারে  চীন দেশে ধানের উৎপাদন বেশ কমে গিয়েছিল। এতে চীন সরকারের টনক নড়লো।

এটা ১৯৫৬ সালের কথা। তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন মাও সেতুং। তিনি ছিলেন চীনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চড়ুই পাখির অত্যাচারের কথা শুনে চেয়ারম্যান মাও সিদ্ধান্ত নিলেন, ধানের উৎপাদন বাড়াতে চীনদেশকে চড়ুই পাখি মুক্ত করতে হবে।‌ তিনি এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। 

কথায় বলে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। দলে দলে আবালবৃদ্ধবনিতা বেরিয়ে পড়লো চড়ুই পাখি নিধন অভিযানে। দেখামাত্র চড়ুই পাখি হত্যা করা শুরু হলো। চড়ুই পাখির বাসা, ডিম, ছানা সব ধ্বংস করা শুরু হল। স্কুলের বাচ্চাদের হাতে গুলতি দেওয়া হলো চড়ুই পাখি মারার জন্য। কে কয়টি চড়ুই পাখি মারতে পারে রীতিমতো তার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। একদল অতি উৎসাহী মানুষ  নেমে পড়লো ড্রাম নিয়ে। যেখানেই চড়ুই পাখি সেখানেই ড্রাম বাজানো শুরু হলো। ড্রামের বিকট শব্দে চড়ুই পাখিরা ভয় পেয়ে আকাশে উড়োউড়ি শুরু করলো। কিন্তু ড্রাম আর থামে না। ড্রামের শব্দে চড়ুই পাখিরা নীচে নামার সাহস পেল না। অনেক পাখি উড়তে উড়তেই ক্লান্ত হয়ে টুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। এছাড়া ফাঁদ পেতে, বিষ দিয়ে বিভিন্ন কায়দায় চড়ুই পাখি মারার দক্ষযজ্ঞ শুরু হলো। সেই সময় এক দিনেই সাংহাই শহরে প্রায় দুই লক্ষ চড়ুই পাখি মারার রেকর্ড রয়েছে। এভাবে মোটামুটি এক বছরের মধ্যেই চীন দেশে চড়ুই পাখির বংশ মোটামুটি ধ্বংস হয়ে গেল। চেয়ারম্যান মাওয়ের নেতৃত্বে চীন দেশের  জনগণ চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে এক বিশাল বিজয় অর্জন করলো। 

কিন্তু পরের বছর, ধান লাগানোর পর নতুন এক বিপত্তি শুরু হল। দেখা গেল, ধান গাছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ অসম্ভব বেড়ে গেছে।কীটনাশক দিয়েও পোকামাকড় দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। ধানের উৎপাদন আরো অনেক কমে গেল। মারাত্মক সমস্যা হলো এর পরের বছর। পঙ্গপালের ভয়াবহ আক্রমণে লক্ষ লক্ষ একর জমির ধান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেল। এর ফলে চীন দেশে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা গেল। ইতিহাসবিদদের ধারণা, সে সময় চীন দেশে দুর্ভিক্ষে ১৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর বেশিও হতে পারে। 

তখন বোঝা গেল, চড়ুই পাখি নিধন করার ফলেই এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। চড়ুই পাখি শুধু জমির পাকা ধানই খেত না, সেই সাথে ধানের ক্ষতিকর পোকামাকড়ও খেয়ে নিত। এর ফলে পোকামাকড়ের সংখ্যা খুব বেশি বাড়তো না। কিন্তু চড়ুই পাখির আধিক্য না থাকাতে, দু'বছরের মধ্যেই পোকামাকড়ের বংশ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে চড়ুই পাখির সমস্যার চেয়ে পোকামাকড়ের উপদ্রব অনেক বেশি মাত্রার ক্ষতি করেছে। চড়ুই পাখি আর কটা ধানই খেত, এখন পঙ্গপাল এসে সব সাবাড় করে দিয়েছে। চেয়ারম্যান মাও তখন তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি চড়ুই পাখি হত্যা করার আদেশ প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। 

এটাই হলো প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতিতে জীবজগতের ভেতর নানা রকম ভারসাম্য থাকে। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতি আপন নিয়মেই এসব ভারসাম্য টিকিয়ে রেখেছে। এটা মানুষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, প্রকৃতি তার রুদ্ররোষ নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। 

মানুষ নির্বিচারে আজ বন উজাড় করছে, জমিতে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার করছে, শিল্প বর্জ্য দিয়ে নদীর পানি দূষণ করছে, যত্রতত্র প্লাস্টিকের বোতল ফেলছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণায় দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। মানুষ বায়ুমণ্ডলে ছড়াচ্ছে ক্ষতিকর গ্রিন হাউজ গ্যাস। এর ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ‌প্রকৃতি দয়াশীল, কিন্তু ক্ষমাশীল নয়। ‌প্রকৃতির রুদ্ররোষ বড়ই ভয়াবহ। ‌এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।

Comments