১৮৪৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় একটি অসাধারণ ছেলের জন্ম হয়েছিল। ছেলেটির নাম লুডউইগ বোল্টজম্যান। ছেলেটি ছিল অত্যন্ত মেধাবী। তাঁর মাথায় সবসময় ঘুরতো গণিত আর বিজ্ঞান।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ছেলেটি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলো। সেখানেই তাঁর সাথে দেখা হলো বিখ্যাত বিজ্ঞানী জোসেফ স্টেফানের। শিক্ষাগুরু স্টেফানের সান্নিধ্যে এসে বোল্টজম্যান পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আরও আকৃষ্ট হলেন এবং খুব দ্রুতই তিনি নাম করলেন বিজ্ঞান জগতে।
বোল্টজম্যান এমন এক সময় পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করছিলেন, যখন পরমাণু যে সত্যিই আছে, তা নিয়েই বিতর্ক চলছিল। তখন অনেক বিজ্ঞানীই বলতেন, "এইসব পরমাণু-টরমাণু কিছু নেই, এ সবই কল্পনা!" কিন্তু বোল্টজম্যান নিজের গবেষণায় প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন, আমাদের চারপাশের সবকিছুই ছোট ছোট অণু ও পরমাণুর সমষ্টি।
তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল
স্ট্যাটিসটিক্যাল মেকানিক্স
নিয়ে। সহজভাবে বলতে গেলে, তিনি দেখিয়েছিলেন কেমন করে ছোট ছোট অণু-পরমাণুর আচরণ গ্যাস, তরল বা কঠিন বস্তুর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।
গ্যাসের গতিবিধি তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। গ্যাসের কণাগুলো আসলে এলোমেলোভাবে ছোটাছুটি করে, আর তাদের গতি-প্রকৃতির ওপরই নির্ভর করে গ্যাসের তাপমাত্রা এবং চাপ। বোল্টজম্যান জানতেন, প্রকৃতিতে সব কিছুই সুশৃংখল অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে যায়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে এনট্রপি। তিনি সমীকরণ দিয়ে গাণিতিকভাবে এনট্রপির ব্যাখ্যা দিলেন।
বোল্টজম্যান সারা জীবন
পরমাণুর অস্তিত্বের পক্ষে লড়াই করেছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সব পদার্থই আসলে ছোট ছোট কণার সমষ্টি। যাকে আজ আমরা পরমাণু বলে চিনি। কিন্তু তাঁর সময়ের বিজ্ঞানীরা এটা মানতে চাইলেন না। বিশেষ করে তখনকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্নস্ট মাখ তাঁর তীব্র সমালোচনা শুরু করলেন। অনেক বিজ্ঞানী তাঁকে সামনাসামনি উপহাসও করতেন। কারণ সে যুগে "পরমাণু" ব্যাপারটা অনেকের কাছে ছিল অলীক কল্পনার মতো।
এত বেশি সমালোচনা আর অবজ্ঞা সহ্য করতে করতে বোল্টজম্যান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। শেষ পর্যন্ত অবসাদগ্রস্ত হয়ে ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯০৬, ইতালির ডুইনো শহরে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। এভাবেই বিজ্ঞানের জগতের এক অনন্য প্রতিভার করুণ মৃত্যু হলো।
তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো, যে তত্ত্বের জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন, মৃত্যুর কয়েক বছর পরে সেটাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সেটা দেখে যেতে পারেননি। আজ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, বোল্টজম্যান একদম সঠিক ছিলেন। তাঁর গবেষণার উপর ভিত্তি করেই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যাটিসটিক্যাল মেকানিক্স গড়ে উঠেছে। এনট্রপির সঠিক গাণিতিক ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছিলেন। শুধু পদার্থবিজ্ঞানে নয়, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিভিন্ন শাখায় তাঁর গবেষণা এখন কাজে লাগছে। যে বিজ্ঞানী একসময় ছিলেন উপেক্ষিত, যাকে ভুল বোঝা হয়েছিল, আজ তাঁর নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাঁর গবেষণা ছাড়া আজকের আধুনিক বিজ্ঞান ভাবা যায় না।
জন্মদিনে এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
Comments