সৌরজগতে প্রাণের সন্ধান: কোথায় লুকিয়ে আছে সম্ভাবনা?

সৌরজগতে পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, সৌরজগতের আরও কিছু স্থানে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে, যেখানে তরল পানি, শক্তির উৎস এবং জৈব রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। সঙ্গত কারণে সেখানেও প্রাণের উন্মেষ ও বিকাশ হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু গ্রহ ও উপগ্রহকে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে প্রাণ হয়তো এখনও আছে অথবা অতীতে ছিল। আসুন, এই সম্ভাব্য স্থানগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নেই।

মঙ্গল: প্রাণের সন্ধানে অভিযান 

মঙ্গল গ্রহ বরাবরই বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। অতীতে এখানে তরল পানির অস্তিত্ব ছিল, মঙ্গলের শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত ও হ্রদের চিহ্ন দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এখনো মঙ্গলের মাটির নিচে তরল পানি আছে, যা অনুজীবের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে। 

গত কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে ৬৮টি‌ মহাকাশযান মঙ্গলে পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে সাতটি এখনো গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করছে। এসব মহাকাশযান থেকে পাওয়া বেশ কিছু ছবিতে দেখা যায়, মঙ্গলের মেরু অঞ্চলে জমাট বাঁধা পানি বরফ হয়ে আছে। এখানে ভূগর্ভে তরল পানি থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। নাসার পাঠানো পারসিভেরেন্স ও কিওরিওসিটি রোভার এখনো সক্রিয়ভাবে মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠ বিশ্লেষণ করছে। গবেষকরা ইতিমধ্যেই মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পেয়েছেন, যা জৈবিক কার্যকলাপের সম্ভাব্য ইঙ্গিত বহন করে। তবে  প্রাণের কোনো নিশ্চিত প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। ২০২৮ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির এক্সোমার্স রোভার মঙ্গল পৃষ্ঠের আরও গভীরে অনুসন্ধান চালাবে।

ইউরোপা: বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা সমুদ্র

বৃহস্পতির অন্যতম চাঁদ ইউরোপা প্রাণের সন্ধানে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থানগুলোর একটি। এটির উপরিভাগ সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা, কিন্তু সেই বরফের নিচে একটি বিশাল তরল পানির মহাসাগর রয়েছে। বৃহস্পতির মহাকর্ষীয় টানের কারণে এই মহাসাগরের অভ্যন্তর উষ্ণ থাকে।  এর ফলে পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টগুলোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীরা ইউরোপার বরফের উপরিভাগে জৈব যৌগের উপস্থিতি পেয়েছেন। ২০৩০ সালে নাসার ইউরোপা ক্লিপার মিশন এই উপগ্রহের বরফের নিচের পরিবেশ বিশ্লেষণ করবে এবং প্রাণের সম্ভাবনা যাচাই করবে।

এনসেলাডাস: শনির রহস্যময় চাঁদ

শনি গ্রহের এনসেলাডাস নামের চাঁদটিও প্রাণের সম্ভাব্য ঠিকানা হতে পারে। এটি বরফে ঢাকা হলেও, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে এর ভিতরে একটি লবণাক্ত পানির সমুদ্র লুকিয়ে রয়েছে। নাসার ক্যাসিনি মহাকাশযান এই চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে গরম পানির প্রস্রবণ মহাকাশে নির্গত হবার ছবি পাঠিয়েছে। এতে বোঝা যায়, এনসেলাডাসে বরফের নিচে পানি বেশ উষ্ণ। এটা প্রাণের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে পারে। ক্যাসিনি মহাকাশযান এনসেলাডাসের উষ্ণ জলীয় প্রস্রবণ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, সেখানে কার্বন যৌগ এবং সম্ভাব্য জৈবিক উপাদান রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পৃথিবীর গভীর সমুদ্রের মতোই এনসেলাডাসে  হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আশেপাশে ব্যাকটেরিয়া জাতীয় প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে।

টাইটান: মিথেন-ভিত্তিক প্রাণের সম্ভাবনা

শনি গ্রহের আরেকটি চাঁদ টাইটান, যেখানে প্রাণের এক ভিন্ন সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীর মতোই টাইটানের উপরিভাগে বড় বড় হ্রদ ও সমুদ্র আছে, তবে সেগুলো পানি নয়, বরং তরল মিথেন ও ইথেনে পরিপূর্ণ। এখানে যদি প্রাণ থেকে থাকে, তাহলে সেটি আমাদের পরিচিত জল-ভিত্তিক প্রাণের চেয়ে একেবারে আলাদা হবে। টাইটানের ঘন বায়ুমণ্ডলে জটিল হাইড্রোকার্বন পাওয়া গেছে। এটা প্রাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান সরবরাহ করতে পারে। ২০২৭ সালে উৎক্ষেপণের পর, নাসার ড্রাগনফ্লাই মিশন টাইটানের পরিবেশ বিশ্লেষণ করবে এবং সম্ভাব্য প্রাণের সন্ধান করবে।

গ্যানিমিড: সৌরজগতের সবচেয়ে বড় চাঁদ

বৃহস্পতির আরেক চাঁদ গ্যানিমিড প্রাণের সম্ভাবনাময় স্থান হতে পারে। এটি সৌরজগতের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ, এর ব্যাস পৃথিবীর আড়াই ভাগের একভাগ। এর অভ্যন্তরে লবণাক্ত পানির সমুদ্র আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্যানিমিডের নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র রয়েছে, যেটা সৌর বিকিরণের হাত থেকে প্রাণের সুরক্ষা দিতে পারে। ২০৩১ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির জুস (JUICE) মিশন, গ্যানিমিডের সমুদ্রের পানির জৈব বিশ্লেষণ করবে।

শুক্র গ্রহ: মেঘের ওপরে প্রাণের ইঙ্গিত?

শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠ অত্যন্ত গরম এবং প্রতিকূল হলেও, এর বায়ুমণ্ডলের ৫০-৬০ কিলোমিটার উচ্চতায় তুলনামূলক সহনীয় পরিবেশ রয়েছে। ২০২০ সালে বিজ্ঞানীরা শুক্রের বায়ুমণ্ডলে ফসফিন গ্যাস শনাক্ত করেছেন, যেটা পৃথিবীতে মূলত জীবাণুগুলো উৎপন্ন করে। এই তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, শুক্রের মেঘমণ্ডলে অনুজীব থাকতে পারে। নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ভবিষ্যতে শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলের পরিবেশ বিশ্লেষণ করার পরিকল্পনা করছে।

ট্রাইটন: নেপচুনের রহস্যময় চাঁদ

নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটনও প্রাণের জন্য সম্ভাবনাময় স্থান হতে পারে।  এটি একটি অত্যন্ত ঠান্ডা, বরফে ঢাকা উপগ্রহ। তবে এখানেও গিজারের মতো জলীয় প্রস্রবণ দেখা গেছে।  এতে মনে হয়, অভ্যন্তরের উত্তাপে পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, বরফের নিচে একটি লবণাক্ত পানির মহাসাগর রয়েছে, যেখানে ক্ষুদ্র অনুজীবের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। যদিও ট্রাইটন নিয়ে গবেষণা এখনো সীমিত, তবে ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আরও বিশদ অনুসন্ধান চালানো হবে।

সৌরজগতের কোথায় প্রাণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি?

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মঙ্গল গ্রহ, বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা এবং শনির উপগ্রহ এনসেলাডাসে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ, এই স্থানগুলোতে তরল পানি, শক্তির উৎস এবং জৈবিক রাসায়নিক যৌগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। টাইটান ও শুক্রের মেঘমণ্ডলে প্রাণের বিকল্প রূপ থাকতে পারে, যেখানে জীবন পানি-ভিত্তিক না হয়ে মিথেন বা সালফিউরিক অ্যাসিড-ভিত্তিক হতে পারে। গ্যানিমিড ও ট্রাইটনের মতো উপগ্রহগুলোতেও প্রাণের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যদিও সেখানে প্রাণ টিকে থাকার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম।
বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনাগুলো যাচাই করতে একের পর এক মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করছেন। ইউরোপা ক্লিপার, ড্রাগনফ্লাই, জুস মিশনসহ ভবিষ্যতের আরও অনুসন্ধানী মিশনের মাধ্যমে হয়তো একদিন আমরা পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাব। যদি তা কখনো সত্যি হয়, তাহলে সেটি হবে মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার!

Comments