গত দু'দিন ধরেই আকাশ মেঘে ঢাকা। আবহাওয়ার রিপোর্টে বলেছে, ৮ এপ্রিল দুপুর একটার দিকে ঝড় বৃষ্টি হবার ৮৫% সম্ভাবনা আছে। কেমন লাগে বলুন? সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে টেক্সাসে এসেছি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য। আকাশে মেঘ থাকলে কিছুই দেখা যাবে না। আর ঝড় বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। আমার শখের ক্যামেরা, লেন্স, যন্ত্রপাতি সব তো ভিজে একাকার হয়ে যাবে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে। এসব ভেবে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
তবে অভয় দিল আমার ছোট ভাই, তাসনিম হোসেন এমিল Tasnim Hossain । ও পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। অনেক বছর ধরেই টেক্সাসে আছে । এমিলের লেখালেখির হাত কিন্তু দারুণ। মুগ্ধ হবার মতো লেখা। এমিল জানালো, টেক্সাসের আবহাওয়া খুবই আনপ্রেডিক্টেবল। ঘন্টায় ঘন্টায় চেঞ্জ হয়। সুতরাং শেষ মুহূর্তে একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারে। ওর কথা সান্তনার বাণী মনে হলো। খুব একটা ভরসা পেলাম না। গত দুদিনের আবহাওয়া রিপোর্ট মিলিয়ে দেখলাম, বেশ নির্ভুল মনে হলো। অগত্যা কি আর করা, মনে মনে সেই বিখ্যাত গানের কলি গুনগুন করতে থাকলাম, কে সারা সারা। হোয়াটএভার উইল বি, উইল বি। যা হবার তা তো হবেই। এ নিয়ে দুঃখ করে লাভ কি আর ?
৮ তারিখ সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনটা আবারও বিষন্ন হয়ে উঠলো। পুরো আকাশ জুড়ে থরে থরে মেঘ। সূর্যিমামার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। কথায় বলে, মর্নিং শোজ দি ডে। আবহাওয়া রিপোর্ট তখনো বলছে, দুপুর একটার দিকে ঝড় বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। তবে সম্ভাবনা কমে ৩৫% হয়েছে। তার মানে বৃষ্টি না হবার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু মেঘ? আকাশ জুড়ে ভারী মেঘ দেখা যাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে মেঘের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হলো, দক্ষিণের গালফ অফ মেক্সিকো থেকে মেঘরাশি উত্তরে ডালাসের দিকে ভেসে যাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে মনে হলো, পশ্চিম দিকে আকাশে মেঘ কিছুটা কম। এমিলকে বললাম, চলো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, পশ্চিম দিকটা একটু দেখে আসি। তখন সকাল দশটা বাজে। আধাঘন্টা দূরে গিয়ে বুঝলাম এদিকে মেঘ কিছুটা কম থাকলেও, একেবারে কম নয়। সূর্য মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু একটু পরেই আবার মেঘের ঘোমটায় সূর্য মুখ ঢেকে ফেলছে। সূর্যের লুকোচুরি খেলা দেখে বুঝলাম এভাবে অযথা ঘুরাঘুরি করে কোন লাভ নেই। এদিকে সূর্যগ্রহণ শুরুর সময়ও বেশি বাকি নেই। এসব ভেবে আমরা আবার বাসায় ফিরে আসলাম। আকাশ তখনও ঘন মেঘে ঢাকা। বুঝলাম আজ সূর্যগ্রহণ দেখার আর কোনো আশাই নেই।
এর মধ্যে হঠাৎ করেই, ফেইসবুকে একটা আশাব্যঞ্জক খবর পেলাম। একজন জানাচ্ছেন, টেক্সাসের হিল কান্ট্রির মার্বেল ফলসে আকাশ বেশ পরিস্কার। প্রমাণস্বরূপ তিনি মেঘ বিহীন আকাশের একটি ছবিও জুড়ে দিয়েছেন। এই জায়গাটা এখান থেকে কত দূরে? এমিলকে জিজ্ঞেস করাতে ও জিপিএস চেক করে জানালো, এখান থেকে বড়জোর এক ঘন্টা লাগবে। তবে রাস্তায় জ্যাম থাকলে হবে না। হিসেব করে দেখলাম, পথে ঝামেলা না থাকলে ওখানে আমরা দুপুর একটার মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারি। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ শুরু হবে দুপুর একটা ছত্রিশ মিনিটে। ভেবে দেখলাম ওখানে গেলে আমরা পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখলেও দেখতে পারি। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। মারিয়া এবং আনুসাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আমরা রওনা দিয়ে দিলাম।
সৌভাগ্যবশত পথে কোন ঝামেলা হলো না। হিল কান্ট্রিতে পৌঁছে বুঝলাম এখানে মেঘের আনাগোনা কিছুটা কম। মেঘ এখানে অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে আকাশে সূর্যের কিরণ দেখা যাচ্ছে। সূর্যের আলোর মাঝে আশার আলো দেখতে পেলাম।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সরু রাস্তায় মার্বেল ফলসের দিকে যেতে যেতে এক জায়গায় আমরা বেশ কিছু গাড়ি পার্কিং করা দেখলাম। এটা একটা ছোটখাটো ফেডারেল রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা। এমিলকে বললাম, চলো এখানেই আমরা ঢুকি। ঢোকার মুখে বাঁধার সম্মুখীন হলাম। একজন অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কী এখানে আগে থেকে রিজার্ভেশন করা আছে? এমিল না বলতেই, তিনি বললেন, কোন সমস্যা নেই, অনেক ক্যান্সলেশন হয়েছে, ভেতরে এখনো জায়গা আছে, তোমরা ভেতরে যেতে পারো। টিকিট কত লাগবে জিজ্ঞেস করাতে অফিসার জানালেন, কোন পয়সা লাগবে না, সরকারি জায়গা, এখানে পার্কিং ফ্রি। আরে এ তো দেখি, মেঘ না চাইতেই জল। সরকার বাহাদুরকে ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি পার্ক করে, দুই মিনিটের মধ্যে ক্যামেরা সেটআপ করে ফেললাম। এমিল একটা থার্মোমিটার এনেছিল, সেটা ঝুলিয়ে দিল ক্যামেরার ট্রাইপডে। আমরা সবাই চোখে এক্লিপস দেখার কাগজের চশমা লাগিয়ে দিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সূর্যের গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। চাঁদ ধীরে ধীরে সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছে। আকাশে তখনও হালকা মেঘ আছে। কিন্তু গ্রহণ দেখতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। আমি দুটো ক্যামেরা এনেছিলাম। পটাপট কিছু ছবি তুলে নিলাম। ভিউ ফাইন্ডার দেখলাম ছবিগুলো ভালোই এসেছে। ছবি তোলার টেকনিক নিয়ে বেশি কিছু বলছি না। শুধু বলি, স্পেশাল সোলার ফিল্টার ব্যবহার করেছিলাম। এতে হালকা মেঘের ভেতর দিয়েও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।
তন্ময় হয়ে দেখছিলাম, আস্তে আস্তে চাঁদের রাহু গ্রাসে সূর্যের আলো নিভে যাচ্ছে। চারিপাশে এক অদ্ভুত আঁধার নেমে আসছে। এরই মাঝে আকাশে মেঘের আনাগোনাও সমানে চলছে। মাঝে মাঝে মেঘে ঢেকে যাচ্ছে গ্রহণলাগা সূর্য। মেঘের ব্যাপারে কিছুই করার নেই। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ শুরু হতে তখনো ছয় মিনিট বাকি। এসময় ভারী একখন্ড মেঘ সূর্যকে পুরোই ঢেকে দিল। তখন কিছুই আর দেখা যাচ্ছিল না। মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা মিস হয়ে যাবে?
কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, ভারী এই মেঘের খন্ডটি যে গতিতে ছুটে চলেছে, তাতে আর পাঁচ ছয় মিনিটের মধ্যেই মেঘ আবার সরে যাবে। ঠিক তাই হলো। পূর্ণ সূর্যগ্রহনের মাহেন্দ্রক্ষণে মেঘের অবগুন্ঠন থেকে আবার বেরিয়ে আসলো সূর্যমামা। চোখের সামনে তখন দেখলাম চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে। চাঁদের বলয়ের পাশ দিয়ে সূর্যের করোনার ছটা তখনও দেখা যাচ্ছে। চাঁদের বলয়ের কিনারায় বেশ কয়েকটি আলোর বিন্দুও দেখলাম। এগুলোকে বলা হয়, বেইলিস বিডস (Bailey's Beads)। ১৮৩৬ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস বেইলি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় দৃশ্যমান এসব বিন্দু বিন্দু আলোর উৎসের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছেন, চাঁদের পৃষ্ঠটি মোটেই মসৃণ নয়। চাঁদের মাটিতে রয়েছে নানা গিরিখাত এবং পাহাড় পর্বত। চাঁদ যখন সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়, তখনও চাঁদের অমসৃণ পৃষ্ঠের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলো কিছুটা দেখা যায়। এগুলিই হলো, বেইলিস বিডস।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ প্রায় চার মিনিট স্থায়ী ছিল। এ সময় ক্যামেরার সোলার ফিল্টার খুলে নিয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। মাঝে মাঝে চাঁদের বলয়ের পেছনে লাল রঙের সোলার প্রমিনেন্স দেখা যাচ্ছিল। এর কয়েকটা ক্লোজআপ ছবি তুলতে পারলাম। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীতে। এটা ঠিক গোধূলি নয়, আবার পুরোপুরি রাতের আঁধারও নয়। এটা এক অলৌকিক অন্ধকারের আলো। এই আলোর বর্ণনা দেওয়া খুবই কঠিন। আমার চারপাশের সব মানুষই তখন খুব উতলা হয়ে উঠেছিল। আমিও নিজের মধ্যেই একটা অদ্ভুত উত্তেজনা উপলব্ধি করতে পারছিলাম। আকাশে তাকিয়ে দেখলাম কয়েকটি তারা উঁকি দিচ্ছে। এই দৃশ্য কি কখনো ভোলা যায়?
এরপর ঘটলো, পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সবচেয়ে অবিস্মরণীয় দৃশ্য। এটা হলো, ডায়মন্ড রিং। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ঠিক ছাড়ার সময় চাঁদের বলয়ের নিচে এক উজ্জ্বল আলোর সৃষ্টি হলো। মনে হলো, আকাশে বিশাল এক হীরের আংটি ঝুলে আছে। প্রায় ১০ থেকে ১২ সেকেন্ড স্থায়ী ছিল অদ্ভুত এই আলোর ঝলকানি। ডায়মন্ড রিংয়ের ব্যাখ্যাও ফ্রান্সিস বেইলি দিয়ে গেছেন। এটাও চাঁদের অমসৃণ পৃষ্ঠের জন্যই হয়।
তারপর ধীরে ধীরে গ্রহণমুক্ত হওয়া শুরু করলেন দিনমণি। ভারী মেঘের আনাগোনাও আবার বেড়ে গেল। তবে আমাদের পরম সৌভাগ্য, পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ওই মূল্যবান চারটি মিনিট মেঘমুক্ত ছিল। আমরা প্রাণ ভরে দেখতে পেলাম একটি মহাজাগতিক ঘটনা, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। ক্যামেরায় দেখলাম ছবিগুলোও ভালোই এসেছে।এমিলের কথা শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, টেক্সাসের আবহাওয়া আসলেই আনপ্রেডিক্টেবল। আর আমিও মনে মনে ভাবলাম, সব ভালো তার, শেষ ভালো যার।
Comments