আমাদের বাসভূমি পৃথিবী সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী।সৌরজগতের সূচনা লগ্নে প্রায় একই সময়ে চাঁদ এবং পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। এটি প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগের ঘটনা। সেই থেকে মাধ্যাকর্ষণের বাঁধায় পড়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে চাঁদ। পৃথিবীর সাথে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। মহাজাগতিক স্কেলে এটি অতি সামান্য দূরত্ব। খুব কাছেই বলা যায়। চাঁদ থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে মাত্র ১.৩ সেকেন্ড।
সৌরজগতে চাঁদ পৃথিবীর কতটা কাছে, সেটা দেখতে হলে যেতে হবে বেশ খানিকটা দূরে। ২০০৪ সালে নাসার রোবটিক মহাকাশযান মেসেঞ্জারকে বুধ গ্রহে পাঠানো হয়েছিল। এর কাজ ছিল খুব কাছ থেকে বুধ গ্রহকে পর্যবেক্ষণ করা। উৎক্ষেপণের প্রায় সাত বছর পর মেসেঞ্জার বুধ গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১০ সালের ৬ মে, বুধ গ্রহের কক্ষপথের কাছাকাছি অবস্থান থেকে মেসেঞ্জারের ক্যামেরায় পৃথিবী এবং চাঁদের একটি যুগল ছবি তোলা হয়েছিল। তখন মেসেঞ্জারের সাথে পৃথিবী এবং চাঁদের দূরত্ব ছিল ১৮৩ মিলিয়ন কিলোমিটার। এই দূরত্ব থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবী থেকে চাঁদ কতটা কাছে। এই ছবিটি যতবারই দেখি ততবারই বিস্মিত হই। অথচ পৃথিবী থেকে চাঁদের এইটুকু দূরত্ব পাড়ি দেওয়াটাই কতটা কঠিন কাজ।
পৃথিবীর মাত্র চারটি দেশ এ পর্যন্ত চাঁদের মাটিতে সফলভাবে অবতরণ করতে পেরেছে। আসলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের প্রবল বাধাটা অতিক্রম করা খুব সহজ নয়। ওদিকে চাঁদে সফট ল্যান্ডিং করাটাও কঠিন কাজ।
এখানে বলে রাখি, পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৭.৩ দিন। মজার ব্যাপার হলো, নিজের অক্ষের উপর একবার ঘুরে আসতেও চাঁদের ২৭.৩ দিন সময় লাগে। সেজন্য চাঁদ নিজের অক্ষের উপর ঘুরলেও, পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদের একটি পিঠকেই দেখতে পাই। একে বিজ্ঞানীরা বলেন, "টাইডালি লকড" অবস্থা। অর্থাৎ, চাঁদের একটি পিঠই সব সময় পৃথিবীর দিকে ফিরে থাকে। অপর পিঠটি থাকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে। চাঁদের অপর পিঠকে সাধারণ ভাষায় বলা হয়, "ডার্ক সাইড অফ দ্য মুন"। কিন্তু এটি টেকনিক্যালি ঠিক নয়। চাঁদের অপর পিঠেও সূর্যের আলো পড়ে কিন্তু সেটা আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই না। সেজন্য চাঁদের অপর পিঠকে "ফার সাইড অব মুন" বলাটাই যুক্তি সংগত।
চাঁদ উপগ্রহ কিন্তু হিসেবে নেহাত ছোট নয়। চাঁদ সৌরজগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ। চাঁদের ব্যাসার্ধ পৃথিবীর ব্যাসার্ধের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। সৌরজগতে পৃথিবীর মতো মাঝারি সাইজের গ্রহের এত বড় উপগ্রহ আর নেই। চাঁদের উপর যেমন পৃথিবীর প্রবল প্রভাব রয়েছে, পৃথিবীর উপরেও চাঁদের মহাকর্ষের প্রভাব রয়েছে। চাঁদের আকর্ষণের জন্যই পৃথিবীতে জোয়ার ভাটা হয়।
আসলে সৌরজগতে পৃথিবী এবং চাঁদ খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। চাঁদ যদি না থাকতো তাহলে পৃথিবীর পরিবেশ হতো প্রতিকূল। সমুদ্রে জোয়ার ভাটার পরিমাণ দুই তৃতীয়াংশ কমে হয়ে যেত। উপকূলবর্তী সামুদ্রিক জীবের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তো। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, সমুদ্রের খাদ্য শৃংখল এর ফলে ভেঙে পড়তো। জোয়ার ভাটা কম হওয়াতে সমুদ্র স্রোতের গতিও পরিবর্তিত হতো। এর বিরূপ প্রভাব পড়তো জলবায়ু উপর। ফলে পৃথিবীর আবহাওয়া হয়ে উঠতো চরম ভাবাপন্ন। জীবজগতের জন্য যেটা মোটেই সুখকর নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চাঁদের মহাকর্ষ পৃথিবীকে তার কক্ষপথে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় রেখেছে। আমরা জানি, পৃথিবী তার কক্ষপথে ২৩.৫ ডিগ্রী হেলে রয়েছে, যার ফলে ঋতু পরিবর্তন হয়। এর পেছনেও কিন্তু চাঁদের মহাকর্ষের ভূমিকা রয়েছে। চাঁদ না থাকলে এই হেলে থাকার পরিমান আরো অনেক কম অথবা অনেক বেশি হতে পারতো। এর ফলে পৃথিবীর আবহাওয়া হয়ে উঠতো চরম বৈরী। মোদ্দা কথা হলো, চাঁদ মামা না থাকলে ধরণী মাতার জীবন হতো ওষ্ঠাগত।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, চাঁদ পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। নাসার বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, এই সরে যাওয়ার পরিমাণ হলো বছরে ৩.৮ সেন্টিমিটার। এটা অবশ্য বিশাল কোন দূরত্ব নয়। আমাদের হাতের নখও এই রকম গতিতেই বাড়ে। সুতরাং চাঁদ মামা খুব শীগ্রই আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। চাঁদ মামা পৃথিবীর দোসর হয়ে থাকবে আগামী আরো কয়েক বিলিয়ন বছর। এর মধ্যে খুব শিগগিরই মানুষ চাঁদে গিয়ে বসতি স্থাপন করে ফেলতে পারবে বলে আশা করা যায়।
Comments