নিষিদ্ধ দ্বীপ

বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশির মাঝে ছোট্ট একটি সবুজ দ্বীপ। আয়তনে মাত্র ছাপ্পান্ন বর্গ কিলোমিটার। পুরো দ্বীপটি ঘন  জঙ্গলে ঢাকা। দ্বীপের চতুর্দিকে রয়েছে প্রবালের শুভ্র প্রাচীর। ছোট্ট এই দ্বীপটি ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অংশ। আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে এর দূরত্ব মাত্র ২০ নটিক্যাল মাইল। দ্বীপটির নাম, নর্থ সেন্টিনিয়েল আইল্যান্ড। কাগজে কলমে দ্বীপটি ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার অংশ হলেও এখানে ভারত সরকারের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। ভারত সরকার এই দ্বীপে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। ‌এই দ্বীপের পাঁচ কিলোমিটার পরিসীমার মধ্যে জল ও অন্তরীক্ষে প্রবেশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই দ্বীপের আশেপাশে ভারতের নৌবাহিনীর জাহাজ নিয়মিত টহল দেয়। এটি একটি এক্সক্লুশন জোন। 

এর কারণ হলো, নর্থ সেন্টিনিয়েল আইল্যান্ডে বসবাস করে একদল আদিবাসী মানুষ। এদের সুরক্ষা করাই এই এক্সক্লুশন জোনের উদ্দেশ্য। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, আধুনিক  সভ্যতার কোন কিছুই এখনো এই দ্বীপের আদিবাসীদের স্পর্শ করতে পারে নাই। এই দ্বীপের মানুষেরা এখনো বাস করছে মানব সভ্যতার আদিম যুগে। বন্যপ্রাণী শিকার, মাছধরা এবং গাছপালা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে এরা জীবন যাপন করে। ধারণা করা হয়, গত দশ হাজার বছর ধরে তারা এই দ্বীপে এভাবেই  টিকে রয়েছে। এদের সাথে বাইরের পৃথিবীর মানুষের কোন যোগাযোগ নেই। এদেরকে বলা হয়, সেন্টিনিলেজ পিপল। এদের ভাষা কারো জানা নেই। এদের সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে আধুনিক মানুষেরা কিছুই জানে না। তবে যতদূর জানা যায়, এই আদিবাসী মানুষরা তাদের নিজেদের মতো করেই প্রকৃতির মাঝে বসবাস করে। বাইরের জগতের মানুষকে তারা সন্দেহের চোখে দেখে। এরা আসলে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যায় বড়জোর ৫০ থেকে ২০০ জনের মত হবে। তীর ধনুক দিয়ে শিকার করতে এরা সিদ্ধহস্ত। নৌকা অথবা হেলিকপ্টার নিয়ে এই দ্বীপের কাছাকাছি কেউ গেলে, তীর ছুড়ে আদিবাসীরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। দূরে চলে যেতে বলে।  কেউ যদি ভুল করে এই দ্বীপে পদার্পণ করে, তার ভাগ্যে জুটে নিশ্চিত মৃত্যু। নর্থ সেন্টিনিয়েল দ্বীপের আদিবাসীরা বহিরাগতকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। মোদ্দা কথা হলো, বাইরের যে কোন মানুষকে তারা শত্রু মনে করে। বাইরের কোন হস্তক্ষেপ তাদের পছন্দ নয়। ওরা ওদের মত করেই থাকতে চায়। 

নব্বইয়ের দশকে একবার তাদের সাথে সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে, ছাব্বিশ বছরের তরুণ এক মার্কিন ধর্মযাজক খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই দ্বীপে পদার্পণ করেছিলেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপের স্থানীয় এক জেলেকে ঘুষ দিয়ে রাজি করিয়ে রাতের অন্ধকারে নৌকা নিয়ে নর্থ সেন্টিনিয়েল আইল্যান্ডের উপকূলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সাঁতার কেটে দ্বীপে পদার্পণ করেছিলেন। দুঃখের বিষয় হলো, স্থানীয় অধিবাসীরা তাকে দেখতে পেয়ে তীর ধনুক দিয়ে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে। দূর থেকে নৌকায় বসে জেলেটি এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। পরবর্তীতে ওই জেলের বয়ানে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা জানা যায়। নিষিদ্ধ ওই দ্বীপ থেকে তরুণ মিশনারির দেহাবশেষও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের বিশেষ আইন অনুযায়ী নর্থ সেন্টেনিয়াল দ্বীপের আদিবাসীরা কোন বহিরাগতকে হত্যা করলে তার কোন বিচার হবে না। এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। এই ঘটনা নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক "দি মিশন" নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে।‌ 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নর্থ সেন্টিনিয়েল দ্বীপের আদিবাসীরা বহিরাগতদের কেন এত অপছন্দ করে? এর পেছনে কিছু ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। আন্দামান এবং নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে একসময় বিভিন্ন আদিবাসীদের বসবাস ছিল। ব্রিটিশ কলোনিয়াল যুগে এসব আদিবাসীরা মূল ভূখণ্ডের মানুষের সংস্পর্শে আসা শুরু করে। এর ফলে আদিবাসীরা নানা ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। আন্দামানের মূল দ্বীপ থেকে কিছুটা দূরে থাকায় নর্থ সেন্টিনিয়েল দ্বীপের আদিবাসীরা এসব সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। বলাই বাহুল্য, বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাদের ছিলনা এবং এখনো সেটা নেই। ১৮৮০ সালে একজন ব্রিটিশ কলোনিয়াল অফিসার নর্থ সেন্টিনিয়েল দ্বীপে গিয়ে ছয়জন আদিবাসীকে জোর করে ধরে নিয়ে দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপে নিয়ে এসেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এদের নিয়ে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করা। এর মধ্যে দুজন ছিল প্রাপ্তবয়স্ক এবং চারজন শিশু। দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপে যাবার পর, এরা সবাই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন মারা যায়। অসুস্থ চারজন শিশুকে ব্রিটিশরা আবার নর্থ সেন্টেনিয়াল দ্বীপে ফেরত দিয়ে আসে। সেই চারজন শিশুর ভাগ্যে কি ঘটেছিল সেটা অবশ্য আর জানা যায়নি। তবে এটি স্পষ্ট বোঝা যায়, এ ঘটনার পর থেকে নর্থ সেন্টিনিয়াল  দ্বীপের আদিবাসীরা বহিরাগতদের সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। 

২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে ভয়াবহ  সুনামির পর আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অনেক অঞ্চল প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। পোর্ট ব্লেয়ারের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। সুনামির কিছুদিন পর ভারত সরকার নর্থ সেন্টিনিয়েল দ্বীপে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে আদিবাসীদের খোঁজ নিয়ে দেখেছেন তারা সেখানে বহাল তবিয়তেই রয়েছে। হেলিকপ্টারের দিকে তীর ছুঁড়ে আদিবাসীরা তাদের স্বাভাবিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এখনো মাঝে মাঝে নর্থ সেন্টিনিয়েল দ্বীপে ড্রোন পাঠিয়ে আকাশ থেকে আদিবাসীদর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এসব ড্রোন ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, প্রকৃতির সন্তানেরা প্রকৃতির মাঝে আনন্দে বসবাস করছে। বাইরের গোলযোগপূর্ণ পৃথিবীর কোন কিছুই তাদের স্পর্শ করছে না। এভাবেই নিষিদ্ধ থাকুক নর্থ সেন্টিনিয়েল দ্বীপ এবং তার আদিম আদিবাসীরা।

Comments