পরাগায়ন ছাড়াই ধান গাছে বীজ উৎপাদনের একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের একদল বিজ্ঞানী। এই টিমের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশী জিন বিজ্ঞানী ডক্টর আবেদ চৌধুরী।
প্রকৃতিতে কিছু কিছু ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে যেগুলো পরাগায়ন ছাড়াই বীজ উৎপাদন করতে পারে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে এপোমিক্সিস (Apomixis)। কিন্তু বেশিরভাগ সপুষ্পক উদ্ভিদেই এটি প্রাকৃতিকভাবে সম্ভব হয় না।
গত কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা পরাগায়ন ছাড়া সপুষ্পক উদ্ভিদে বীজ উৎপাদন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই বিষয়ে নব্বইয়ের দশকে গবেষণা শুরু করেছিলেন ডক্টর আবেদ চৌধুরী। তিনি পরাগায়ন ছাড়াই সরিষা জাতীয় উদ্ভিদ অ্যারাবিডপসিস থ্যালিয়েনার (Arabidopsis thaliana) বীজ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছিলেন ফিস (fis) জিন মিউটেন্ট। ফিস হচ্ছে, ফার্টিলাইজেশন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিড (fertilisation independent seed) এর সংক্ষিপ্ত নাম। তিনি অ্যারাবিডপসিসে তিনটি ফিস জিন শনাক্ত করেন। সেই সাথে তিনি ক্রোমোজোমের ভেতর জিন তিনটির অবস্থান চিহ্নিত করেন। ১৯৯৭ সালে তাঁর এই গবেষণাপত্রটি বিশ্বখ্যাত PNAS জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেই সময় বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
এরপর থেকে বিজ্ঞানীরা ধান গাছে পরাগায়ন ছাড়া বীজ উৎপাদন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক বিজ্ঞানী প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেন। এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর ভেঙ্কটসান সুন্দরাসান। তাঁরা প্রথমে ক্রিসপার জিন নক আউট পদ্ধতিতে ধানের মেয়োসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে সক্ষম হন। এর ফলে ধানের ডিম্বাণুর ভেতরে ক্রোমোজোমের সংখ্যা অপরিবর্তিত রইলো। অর্থাৎ ধানের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য গুলো ডিম্বাণুর ভেতর অক্ষুন্ন থাকলো। তারপর তাঁরা সেই ডিম্বাণুর ভেতর BBM1 (baby boom 1) নামে একটি বিশেষ জিন এডিটিং করে যুক্ত করে দিলেন। প্রকৃতিতে ধানের BBM1 জিনটি আসে পরাগরেণু, অর্থাৎ ধানের পুংকেশর থেকে। এই জিনের উপস্থিতির জন্যই নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে পূর্ণাঙ্গ বীজের সৃষ্টি হয়। এভাবেই ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পরাগরেণুর সাহায্য ছাড়াই জিন এডিটিংয়ের মাধ্যমে ধানের ডিম্বাণুকে পূর্ণাঙ্গ বীজে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হলেন। অর্থাৎ পরাগায়ন ছাড়াই তারা ধান বীজের জন্ম দিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে ধান বীজ উৎপাদনের সাফল্যের হার মাত্র ৩০ শতাংশ। ফলে এই পদ্ধতিটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু সম্প্রতি এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছেন অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতিতে ধান গাছে পরাগায়ন ছাড়াই বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে তাঁরা বেছে নিয়েছেন দুটো ভিন্ন জিন। এই দুটো জিন হলো, ডিম্বানুর পলিকম্ব রিপ্রেসিভ কমপ্লেক্স জিন Osfie1এবং Osfie 2 । এ দুটো জিনকে ক্রিসপার পদ্ধতিতে সরাসরি নক আউট বা নিস্ক্রিয় করে দিয়ে তাঁরা দেখিয়েছেন, এভাবে কোন পরাগায়ন ছাড়াই ধানের ডিম্বাণু থেকে ভ্রুণ এবং পূর্ণাঙ্গ এন্ডোস্পার্ম সহ বীজ গঠণ করা সম্ভব। এই নূতন পদ্ধতিটি ক্যালিফর্নিয়ার বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত পদ্ধতির চেয়ে সহজ এবং অনেক বেশি কার্যকর। এই সরাসরি পদ্ধতির সুবিধা হলো, এতে অধিক মাত্রায় ধান বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা সংস্থার (CSIRO) বিজ্ঞানী ডক্টর মিং লু। তিনি এর আগে ডক্টর আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে fis জিন মিউটেন্ট গবেষণায় সংযুক্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ধানের এই দু'টো Osfie1 এবং Osfie 2 জিন ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত তিনটি fis জিনেরই অনুরূপ (orthologus) জিন। ধানের ক্ষেত্রে পরাগায়ন বিহীন বীজ উৎপাদন করার মাধ্যমে তাঁদের ছাব্বিশ বছর আগে শুরু করা গবেষণা কাজের সফল পরিসমাপ্তি হলো।
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে এই নূতন পদ্ধতিতে হাইব্রিড ধানের বীজ থেকে বংশপরম্পরায় হাইব্রিড ধান উৎপাদন করা যাবে। এটা বাণিজ্যিকভাবে করা গেলে, কৃষকরা তখন নিজেরাই পরবর্তী মৌসুমের জন্য হাইব্রিড বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্ষেত্রেও এই আবিষ্কারটির আশা জাগানিয়া সম্ভাবনা রয়েছে। পরাগায়নের সময় বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেড়ে গেলে ধানের পরাগরেণু নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ধান চিটা হয়ে ফলন কমে যাবার লক্ষণ দেখা যায়। ভবিষ্যতে পরাগায়ন ছাড়া ধান উৎপাদন করা সম্ভব হলে কৃষি ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উষ্ণতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজতর হবে।
ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশা-জাগানিয়া এই আবিষ্কারটির জন্য সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের সকলকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।
এ বিষয়ে তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত জার্নাল নেচার প্ল্যান্টসের (Nature Plants) অনলাইন সংস্করণে।
ছবি কৃতজ্ঞতা: নেচার ডট কম।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য :
https://www.nature.com/articles/s41477-023-01536-4?fbclid=IwAR1LSlJYmmn7HsK-E1ZxMV_X0cytY1rdFx7tJXdLIRjDGS69xBc2yUoZ26I
Comments