পৃথিবীতে আমরা শুধু বর্তমানকে দেখতে পাই। অতীত আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতি।
কিন্তু অতীতকে কি দেখা সম্ভব? যদি বলি এই পৃথিবীতে দেখা সম্ভব না হলেও, মহাকাশে অতীতকে দেখা সম্ভব, তাহলে অবাক হবেন না। সেজন্য কষ্ট করে মহাকাশকে একটু পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
মহাশূন্যে আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯২ কিলোমিটার বা প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এই গতিতে আলো এক বছরে যে পথ অতিক্রম করে তাকে বলা হয়, এক আলোকবর্ষ। এটি দূরত্বের একক। বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ করার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই একক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। কিলোমিটারের হিসাবে এক আলোকবর্ষ সমান ৯.৪৬১ × ১০^১২ কিলোমিটার।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হলো ১৫২.০৮ মিলিয়ন কিলোমিটার। এই দূরত্ব থেকে পৃথিবীতে সূর্যের আলো আসতে সময় নেয় ৮.৩ মিনিট। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসেবে বলা যায়, সূর্য পৃথিবী থেকে ৮.৩ আলোক মিনিট দূরে অবস্থিত। তার মানে হলো, পৃথিবী থেকে সূর্যকে আকাশে আমরা যে অবস্থানে দেখি সূর্য আসলে ৮.৩ মিনিট আগে সেই অবস্থানে ছিল। সূর্যকে আমরা কখনো তার বর্তমান অবস্থানে দেখতে পাই না। আমরা দেখতে পাই সূর্যের ৮.৩ মিনিট অতীতের অবস্থান। কারণ সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে ৮.৩ মিনিট সময় নেয়।
ঠিক এমনিভাবেই, আমরা মহাবিশ্বে যখন কোন নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিকে পর্যবেক্ষণ করি তখন আমরা সেগুলোকে বর্তমান অবস্থায় দেখতে পাই না। আমরা দেখি সেগুলোর অতীতের আলো। যেমন ধরুন, সূর্যের পরে আমাদের নিকটতম নক্ষত্রে হলো, প্রক্সিমা সেন্টারাই। এই নক্ষত্রটি আমাদের থেকে ৪.২৪৬ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। তার মানে হলো, এই নক্ষত্র থেকে পৃথিবী থেকে আলো আসতে সময় নেয় ৪.২৪৬ বছর। অর্থাৎ এই নক্ষত্রটিকে আমরা যখন দেখি, আমরা একে ৪.২৪৬ বছর অতীতের অবস্থায় দেখি। মোদ্দা কথা হলো, মহাবিশ্বের সকল নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির আলোই আমাদের জন্য অতীতের আলো। এদের বর্তমান অবস্থা আমরা কখনো দেখতে পাই না। আমরা দেখি এদের অতীতের অবস্থা। আলোর গতির সীমাবদ্ধতার জন্যই এটা সম্ভব।
আমাদের চেনা মহাবিশ্বে দুই ট্রিলিয়নের বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে। তবে সংখ্যাটা এর চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে। মহাবিশ্ব যে কত বিশাল, তার পরিমাপ করতে গেলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এখন থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যা়ংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। সেই হিসেবে, ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দুর থেকে পৃথিবীতে আলো আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে, ১৩.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে, এর নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন HD1। বিজ্ঞানীদের ধারণা এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। এটি শনাক্ত করা হয়েছে চিলিতে অবস্থিত অত্যন্ত শক্তিশালী ALMA টেলিস্কোপ দিয়ে। তবে ভূপৃষ্ঠে অবস্থানের কারণে এই টেলিস্কোপের কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন অদূর ভবিষ্যতে, মহাশূন্যে অবস্থিত জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে HD1কে আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ইতিমধ্যেই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা দূর মহাবিশ্বের বেশ কিছু স্পষ্ট ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এই টেলিস্কোপের সক্ষমতা দেখে বিজ্ঞানী মহল উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন। মহাবিশ্বের অতীতের খুঁটিনাটি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার একটি মোক্ষম যন্ত্র পেয়েছেন তাঁরা। আশা করা যাচ্ছে, আদি মহাবিশ্বের অনেক রহস্য জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে উদঘাটিত হবে। বিজ্ঞানের অভিযাত্রায় আরেক ধাপ এগিয়ে গেল মানুষ।
Comments