মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়: ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটার

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের ফলে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো। এরপর থেকে মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ধারণা করা হতো, মহাবিশ্বের প্রসারণ এক সময় থেমে যাবে। তখন মহাকর্ষের প্রভাবে সংকুচিত হওয়া শুরু করবে মহাবিশ্ব। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে কিছু পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে এখন প্রমানিত হয়েছে, মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিতই  হচ্ছেনা, বরং এর প্রসারণের গতি ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের এই তরান্বিত প্রসারণের ব্যাখ্যা দেওয়া খুবই কঠিন কাজ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কোনো এক গুপ্ত শক্তি এর পেছনে কাজ করছে।এই গুপ্ত শক্তিকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন, ডার্ক এনার্জি। এই যুগান্তকারী আবিস্কারটির পেছনে ছিলো তিনজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীর নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা। এরা হলেন, অ্যাডাম রিস, সল পার্লমাটার এবং প্রফেসর ব্রায়ান স্মিড। এই  আবিস্কারটির জন্য  ২০১১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁরা তিনজন যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এখানে বলে রাখি, প্রফেসর ব্রায়ান স্মিড বর্তমানে ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কয়েক বছর আগে তাঁর একটি বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তিনি খুব প্রাঞ্জল ভাষায় ডার্ক এনার্জির  ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মহাবিশ্বের শতকরা ৬৯ ভাগই  হচ্ছে ডার্ক এনার্জি। মহাশূন্যের সর্বত্রই রয়েছে এর সুষম অবস্থান। অন্যভাবে  বলতে হয়, প্রকৃতপক্ষে এটি মহাশূন্যেরই একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহাশূন্য আসলে শুন্য নয়, এর সর্বত্রই রয়েছে ডার্ক এনার্জি। এই গুপ্ত শক্তির প্রভাবেই গ্যালাক্সি গুলোর দূরে সরে যাবার গতি ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। এক কথায় বলতে হয়, মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করছে  ডার্ক এনার্জি। 

ডার্ক এনার্জির উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি। এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। অনেকে মনে করেন, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণ থেকে বাদ পড়া কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের সাহায্যেই ডার্ক এনার্জির সবচেয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। এখানে বলে রাখি, ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ফিল্ড সমীকরণে একটি ধ্রুবকের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ধ্রুবকটির নাম হলো কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট। গ্রীক অক্ষর ল্যামডা দিয়ে তিনি একে চিহ্নিত করেছিলেন। তখন ধারণা করা হতো মহাবিশ্ব চিরকাল স্থির অবস্থায় রয়েছে। পরবর্তীতে যখন মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব আবিষ্কৃত হলো তখন সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণ থেকে ল্যামডাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট হলো তাঁর বিজ্ঞানী জীবনের সবচাইতে বড় ভুল। 

কিন্তু বর্তমান যুগের অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, আইনস্টাইনের  সমীকরণ থেকে বাদ পড়া সেই কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের মাধ্যমেই ডার্ক এনার্জির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। আবার অনেকে মনে করেন, মহাশূন্যের অসীম শূন্যতার মাঝে সর্বদাই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফলে ডার্ক এনার্জির সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এর স্বপক্ষে এখনো কোন পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। ডার্ক এনার্জির রহস্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে। 

ডার্ক এনার্জির পাশাপাশি  বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে এক অদৃশ্য গুপ্ত বস্তুর সন্ধান পেয়েছেন। এর নাম তাঁরা দিয়েছেন ডার্ক ম্যাটার। এ নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করেছিলেন সুইস‌ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি। ১৯৩৩ সালে তিনি কোমা ক্লাস্টার গ্যালাক্সির সব নক্ষত্রের ভর বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারলেন, দৃশ্যমান নক্ষত্রগুলো দিয়ে ঐ গ্যালাক্সি পুঞ্জের প্রবল মহাকর্ষ বলের কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। তাঁর কাছে মনে হলো, ওই গ্যালাক্সিগুলোর ভেতরে আরো অনেক পদার্থ নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে, মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন এবং কেন্ট ফোর্ড অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে নক্ষত্রের গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করে দেখলেন, ঐ গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে দৃশ্যমান পদার্থের চেয়ে অনেক বেশি অদৃশ্য পদার্থ রয়েছে।পরবর্তীতে আরো নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার ফলে প্রমাণিত হয়েছে, বিভিন্ন গ্যালাক্সিতে যে পরিমান দৃশ্যমান বস্তু রয়েছে সেগুলো দিয়ে গ্যালাক্সিগুলোর মহাকর্ষ বলের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। দৃশ্যমান বস্তুর বাইরেও অনেক বেশি অদৃশ্য  বস্তু রয়েছে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে। এটাই হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তু,  যাকে দেখা যায় না, কিন্তু তার মহাকর্ষ বল কাজ করে সমস্ত দৃশ্যমান বস্তুর উপর। বিভিন্ন গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে বিদ্যমান মহাকর্ষ বলের পরিমাপ করে বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ডার্ক ম্যাটার না থাকলে গ্যালাক্সিগুলো গঠিত হতে পারতো না। 

ডার্ক ম্যাটার এক অতি আশ্চর্য বস্তু। আমাদের চেনা পদার্থের সাথে এর কোন মিল নেই। দৃশ্যমান আলো অথবা অন্য কোন তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ  ডার্ক ম্যাটারের সাথে কোন মিথস্ক্রিয়া করে না। সেজন্য ডার্ক ম্যাটারকে দেখা যায় না। শুধুমাত্র মহাবিশ্ব জুড়ে এর মহাকর্ষ বলের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।‌ ডার্ক ম্যাটার কি দিয়ে তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন।  এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এক ধরনের  বস্তুকণার সম্ভাবনার কথা বলেছেন যাদের নাম হলো, WIMP (Weakly Interacting Massive Particles), পরীক্ষামূলক ভাবে WIMP এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেন নি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিশ্বের শতকরা ২৬ ভাগই হলো ডার্ক ম্যাটার আর মাত্র ৫ ভাগ হলো আমাদের পরিচিত  সাধারণ পদার্থ এবং শক্তি। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষের যাবতীয় জ্ঞান এখনো মাত্র  ৫ ভাগ  দৃশ্যমান পদার্থ ও শক্তিকে ঘিরে। মহাবিশ্বের বাকি ৯৫ ভাগ পদার্থ ও শক্তি  হলো ডার্ক ম্যাটার (২৬%)  এবং ডার্ক এনার্জি (৬৯%)। এরা রয়েছে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানুষ এখনো এদের রহস্য বের করতে পারে নি বলেই হয়তো এদের নামের শুরুতে  "ডার্ক" তকমাটি জুড়ে দেয়া হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, ডার্ক এনার্জি আর ডার্ক ম্যাটারের রশি টানাটানি চলছে সেই সৃষ্টির গোড়া থেকে। ডার্ক ম্যাটার টানছে কাছে আর ডার্ক এনার্জি ঠেলছে দুরে। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্ব ‌সৃষ্টির শুরুতে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ ছিল ডার্ক এনার্জির চেয়ে বেশি। কিন্তু বর্তমান মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জির পরিমাণ ‌অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এদের রহস্য রয়েছে এখনও অধরা। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে অতি উচ্চশক্তির পারমাণু বিধ্বংসী পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে মহাবিশ্বের এসব গুপ্ত রহস্যের জট খুলবে।
© Tanvir Hossain 

Comments