কিছু কিছু পণ্য রয়েছে যেগুলো খুবই বিখ্যাত তাদের উৎসের জন্য। অনেক সময় কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় উৎপাদিত পণ্য গুণগত মানের কারণে জনমানুষের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হতে পারে। যেমন ধরুন, ঢাকাই জামদানি, কুমিল্লার রসমালাই, মুক্তাগাছার মন্ডা, পদ্মার ইলিশ, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি, ল্যাংড়া, খিরসাপাত আম , সিলেটের কমলা, দেরাদুনের বাসমতি, ফ্রান্সের শ্যাম্পেন, তাসমানিয়ার পনির ইত্যাদি।
এসব নামের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত । এরকম আরো অনেক হাজারো উদাহরণ আছে সারা পৃথিবী জুড়ে। এসব পণ্যের সমাদর কিন্তু একদিনে হয়নি। যুগ যুগ ধরে উৎপাদনের কৌশলগত দক্ষতা ও কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের কারণে এসব পণ্যের ব্যাপারে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণা জন্মেছে।
বর্তমানে পুরো পৃথিবীটাই একটা অভিন্ন বাজারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে "ইধার কা মাল উধার এবং উধার কা মাল ইধার" একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যেমন ধরুন, আমাদের ঢাকাই জামদানি শাড়ি এত বিখ্যাত, কিন্তু এখন যদি কোনো বিদেশী কোম্পানি তাদের তৈরী শাড়িতে জামদানি সীল মেরে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে তাহলে আমরা কি কিছু করতে পারবো? অথবা কেউ যদি যে কোনো স্পার্ক্লিং সাদা ওয়াইনকে শ্যাম্পেন বলে চলিয়ে দিতে চায় তবে ফ্রান্সের কি কিছু করণীয় আছে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, উপায় আছে।
বাণিজ্যিক কোম্পানির কিছু ট্রেডমার্ক থাকে। সেজন্য আপনি চাইলেই কোকাকোলা নামে কোন পাণীয় তৈরী করতে পারবেন না। করলে নির্ঘাত মামলায় পড়বেন। কিন্তু ট্রেডমার্কের মত এলাকা ভিত্তিক পণ্যের মেধাসত্ব কিভাবে সম্ভব? এ ধারণাটি মাথায় রেখেই প্রথম ভৌগলিক নির্দেশনা বা জিওগ্রাফিকাল ইনডিকেটর ব্যাপারটার প্রচলন হয়েছে। সংক্ষেপে একে বলে, জি আই (GI)।
কোনো দেশ যদি মনে করে, তাদের দেশে কিছু এলাকা ভিত্তিক জি আই রয়েছে যেটা সেই দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরত্বপূর্ণ - তাহলে তাকে রক্ষা করার জন্য সেই দেশকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে নীতিমালা এবং আইন দুটোই প্রণয়ন করতে হবে। তারপর সেই জি আইয়ের তালিকা নিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সবার দৃষ্টিগোচর করার জন্য। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ জটিল । কারণ কিছু কিছু জি আই আছে যার মালিকানা একাধিক দেশ দাবি করতে পারে। যেমন ধরুন, বাসমতি নামটির উপর ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই দাবিদার। এজন্য অনেক সময় সমস্যা হয়। তখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দর কষাকষি করে সেটা সমাধান করতে হয়। যে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি জি আইয়ের ব্যাপারটি দেখাশুনা করে তার নাম হলো, World Intellectual Property Organization সংক্ষেপে, WIPO.
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোট ৭৩টি পণ্যের তালিকা তৈরি করেছে। যেগুলো ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। এদের মধ্যে আছে মাছ, ফলমূল, মিষ্টি, সবজি ও কৃষিপণ্যসহ মোট ৫২টি খাদ্যপণ্য। আর বাকি ২১টি পণ্যের মধ্যে ঢাকাই জামদানি এবং নকশিকাঁথা সহ বিভিন্ন পণ্য অন্তর্ভুক্ত আছে। এগুলোকে রক্ষা করার জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশে জি আই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় বেশ কিছু জি আই ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, পদ্মার ইলিশ, ঢাকাই জামদানি, ঢাকাই মসলিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, রাজশাহীর সিল্ক, দিনাজপুরের কাঁটারি ভোগ ও কালিজিরা চাল, রংপুরের সতরঞ্জি এবং নেত্রকোনার বিজয়পুরের সাদামাটি।
কিন্তু আমরা হারিয়েছি ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথার উপর আমাদের জি আইয়ের অধিকার। আমাদের আইনটি তৈরী করতে বড্ডো দেরি হয়ে গিয়েছিল, তাই আমাদের আগেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার নকশিকাঁথার উপর তাদের দাবী প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মেধাসত্ত্ব আমাদের দেশের সম্পত্তি। একে রক্ষনাবেক্ষণ করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য । এটা না করলে, বিদেশী কোনো কোম্পানি যদি কুমিল্লার রসমালাই বানিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা শুরু করে, তাহলে অবাক হবেন না।
Comments