গ্রেগর জোহান মেন্ডেল (১৮২২-১৮৮৪)

জেনেটিক্সের জনক গ্রেগর জোহান মেন্ডেল ছিলেন একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক। জাতিগতভাবে তিনি ছিলেন জার্মান। তাঁর জন্ম হয়েছিল তৎকালীন অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের এক নিভৃত পল্লীতে। বর্তমানে তাঁর জন্মস্থানটি চেক রিপাবলিকের অংশ।  

মেন্ডেল তাঁর কাজের ফাঁকে  গাছপালা নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি পেশাগতভাবে বিজ্ঞানী ছিলেন না। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতই তিনি নিবিড় পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি গাছপালা নিয়ে শখের বশেই নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। একবার  দুটো ভিন্ন জাতের মটরশুঁটি গাছের মধ্যে সংকরায়ন বা ক্রসিং করে তিনি একটি আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করলেন। মটরশুঁটির গাছগুলোর একটি ছিল লম্বা এবং অপরটি ছিল খাটো।‌ তিনি দেখলেন, সংকরায়নের ফলে প্রথম প্রজন্মের মটরশুঁটির গাছগুলো সব লম্বা হয়েছে। প্রথম প্রজন্মে তিনি কোন খাটো গাছ খুঁজে পেলেন না। তিনি তখন প্রথম প্রজন্মের গাছের বীজ থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মের গাছ জন্মালেন। এবার তিনি লক্ষ্য করলেন, দ্বিতীয় প্রজন্মের গাছগুলো বেশিরভাগ লম্বা হলেও, এদের মধ্যে কিছু কিছু খাটো জাতের গাছ আছে। তিনি হিসেব করে দেখলেন, তিনটি লম্বা গাছের  বিপরীতে রয়েছে একটি করে খাটো গাছ। তিনি তাঁর পরীক্ষাটি বেশ কয়েক বছর ধরে করলেন। এবার তিনি দেখতে পেলেন, লম্বা এবং খাটো গাছের অনুপাত সব সময় ৩:১ থাকছে। 

তিনি তাঁর পরীক্ষায় মটরশুঁটির গাছের উচ্চতা ছাড়াও এর অন্যান্য আরো ছয়টি বৈশিষ্ট্য, যেমন, ফুলের রং এবং অবস্থান; শুঁটির রং এবং আকার; মটর দানার রং এবং আকৃতি, এগুলোও ভালো করে পরীক্ষা করলেন। তিনি দেখলেন, এসব বৈশিষ্ট্যের প্রধান (dominant) এবং প্রচ্ছন্ন  (recessive) দুটো ভিন্নধর্মী রূপ রয়েছে। যেমন, গাছের উচ্চতার ক্ষেত্রে  প্রধান রূপটি হলো লম্বা, প্রচ্ছন্ন রূপটি হলো খাটো। দুটো ভিন্নরূপী উদ্ভিদের মধ্যে সংকরায়ন করলে প্রথম প্রজন্মে শুধুমাত্র  প্রধান রূপটিই প্রকাশ পায়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রধান এবং প্রচ্ছন্ন দুটো রূপ ৩:১ অনুপাতে ফিরে আসে।  

তিনি তখন বুঝতে পারলেন, জীবনের বৈশিষ্ট্যেকে ধারণ করার জন্য এক ধরনের অন্তর্নিহিত উপাদান (factor) রয়েছে। এই উপাদানগুলো স্বতন্ত্রভাবে বংশগতির ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে জীব বৈশিষ্ট্যের ভিন্ন ভিন্ন রূপগুলো পরবর্তী প্রজন্মে পরস্পরের সাথে মিশে না গিয়ে পৃথক পৃথকভাবে প্রকাশিত হয়।  তিনি বুঝতে পারলেন, এই উপাদানগুলোই হলো বংশগতির ধারক এবং বাহক। এদের মাধ্যমেই জীবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।  

মেন্ডেল নয় বছর ধরে মটরশুঁটি নিয়ে তাঁর এই যুগান্তকারী পরীক্ষাটি চালিয়েছিলেন। খুব নিবিড় ভাবে তিনি তাঁর পরীক্ষার ফলাফল  বিশ্লেষণ করেছিলেন। তারপর ১৮৬৫ সালে, তিনি এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মেন্ডেলের  জীবদ্দশায় তাঁর এই কাজের গুরুত্ব সে যুগের বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করতে পারেননি। বেঁচে থাকতে তিনি কোনো স্বীকৃতি পাননি।  

তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশের ৩৫ বছর পর, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তিনজন বিজ্ঞানী স্বতন্ত্রভাবে মেন্ডেলের গবেষণালব্ধ কাজের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা মেন্ডেলের কাজ থেকে বংশগতির সূত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মেন্ডেলের কাজের উপর ভিত্তি করেই জন্ম নিয়েছে, জীববিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা, জেনেটিক্স। বর্তমান যুগে আধুনিক জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জেনেটিক্সের গুরুত্ব অপরিসীম।  

যদিও মেন্ডেলের যুগে  জিনের গঠন সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের কোন ধারণাই ছিল না, কিন্তু নিবিড় পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ফলে তিনি বংশগতির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পেরেছিলেন।  তাঁর সময়ের তুলনায় তিনি অনেক এগিয়ে ছিলেন। একজন গবেষক হিসেবে এটাই ছিল তাঁর সার্থকতা। 

© তানভীর হোসেন

Comments