সূর্যের কক্ষপথে পৃথিবী তার নিজের অক্ষের (axis) উপর প্রতিনিয়তই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। নিজ অক্ষের উপর পুরো একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ২৩ ঘন্টা, ৫৬ মিনিট, ৪ সেকেন্ড। পৃথিবীর এই লাটিমের মত ঘোরার ফলেই প্রতিদিন পূর্ব দিকে সূর্যের উদয় হচ্ছে এবং পশ্চিম দিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। অর্থাৎ এই গতির ফলেই পৃথিবীতে দিন রাত্রি হয়। এটা হচ্ছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি।
পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষরেখা উত্তর এবং দক্ষিণে পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের সাথে দুইটি বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। এই দুইটি ভৌগলিক বিন্দুকে বলা হয়, উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু। বাংলায় এদের সুমেরু এবং কুমেরুও বলে।
ভৌগলিক উত্তর মেরু হলো পৃথিবীর উত্তরতম বিন্দু। ৯০ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশে এর অবস্থান। উত্তর গোলার্ধের সব দ্রাঘিমাংশ এখানে এসে মিলিত হয়েছে। পৃথিবীতে এর উত্তরে আর কিছু নেই। উত্তর মেরুতে দাঁড়ালে সব দিকই দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে।
অন্যদিকে, ভৌগলিক দক্ষিণ মেরু হলো পৃথিবীর দক্ষিণতম বিন্দু। ৯০ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশে এর অবস্থান। পৃথিবীতে এর দক্ষিণে আর কিছু নেই। দক্ষিণ গোলার্ধের সব দ্রাঘিমাংশ এখানে এসে মিলিত হয়েছে। দক্ষিণ মেরুতে দাঁড়ালে সব দিকই উত্তর দিক নির্দেশ করে।
ভৌগলিক উত্তর মেরুর অবস্থান আর্কটিক মহাসাগরের মাঝামাঝি। এখানে সমুদ্রের গভীরতা চার কিলোমিটারের কিছুটা বেশি। বছরের বেশিরভাগ সময় এই অঞ্চলের সমুদ্র ভাসমান বরফ খণ্ডে ঢাকা থাকে। সেজন্য ভৌগলিক উত্তর মেরুতে স্থায়ীভাবে কোন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা দুরূহ ব্যাপার। এখানকার গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে থাকে ০ ডিগ্রী এবং শীতকালে থাকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
অন্যদিকে ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরুর অবস্থান এন্টারটিকা মহাদেশের মাঝামাঝি একটি দুর্গম জায়গায়। এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৩৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ১৯৫৬ সাল থেকে এখানে একটি স্থায়ী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এর নাম হলো আমুন্ডসেন- স্কট সাউথ পোল স্টেশন। এই স্টেশনে সারা বছরই বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ মেরুকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা করে থাকেন। এখানকার গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে থাকে মাইনাস ২৮ ডিগ্রী এবং শীতকালে থাকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বলাই বাহুল্য, দক্ষিণ মেরু উত্তর মেরুর চেয়ে অনেক বেশি শীতল স্থান।
মজার ব্যাপার হলো, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে দুই মেরুতেই শীতকাল এবং গ্রীষ্মকাল ছাড়া আর কোন ঋতু নেই। শীতকালে মেরু অঞ্চলে সূর্যের দেখা মেলে না। গ্রীষ্মকালে ঠিক এর উল্টোটা হয়, তখন মেরু অঞ্চলে সূর্য অস্ত যায় না। তবে মেরু অঞ্চলে সূর্য দিগন্তরেখার খুব বেশি উপরে উঠে না। উত্তর মেরুতে যখন শীতকাল হয়, দক্ষিণ মেরুতে তখন থাকে গ্রীষ্মকাল। কক্ষপথে পৃথিবী কিছুটা হেলে থাকার কারণে দুই বিপরীত মেরুতে একই সময়ে সূর্যের দেখা মেলে না। পৃথিবীর ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর মধ্যে দূরত্ব হলো ২০,০০৪ কিলোমিটার।
ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু ছাড়াও পৃথিবীর আরো দুটো মেরু রয়েছে। এ দুটো হলো পৃথিবীর চৌম্বকীয় মেরু বা ম্যাগনেটিক পোল। পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত লোহা জমাট বাঁধার ফলে এক ধরনের শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবেই কম্পাসের কাঁটা নড়ে উঠে দিক নির্দেশ করে। কম্পাসের কাঁটা একটি চুম্বক। চুম্বকের কাঁটার দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উত্তর মেরুর দিকে ফিরে থাকে। কারণ দুটি চুম্বকের বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ হয় এবং সম মেরুতে হয় বিকর্ষণ।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, উত্তর ও দক্ষিণ চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এদের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, চৌম্বকীয় মেরু ভৌগোলিক মেরুর মত এক জায়গায় স্থির থাকে না। পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত লোহার পরিচলনের (convection) ফলে চৌম্বকীয় মেরুদ্বয় তাদের স্থান পরিবর্তন করে। এমনকি কয়েক লক্ষ বছরের ব্যবধানে এরা সম্পূর্ণ উল্টে যেতে পারে।
পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র মহাকাশে বেশ খানিকটা বিস্তৃত। বলা যায়, পৃথিবীটা মহাকাশে ভাসমান একটি শক্তিশালী চুম্বক। চৌম্বকীয় ক্ষেত্র পৃথিবীকে নানা ধরনের ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্র না থাকলে পৃথিবী নামক গ্রহটি জীবজগতের জন্য বাসযোগ্য হতো না।
© তানভীর হোসেন
Comments