অপর সভ্যতার সন্ধানে

আদিকাল থেকেই মানুষের মনে হয়েছে এই মহাবিশ্বে সে একা নয়।  আদিম মানব রাতের আকাশে অসংখ্য তারার মেলা দেখে বিস্ময়ে হতবাক  হয়েছে।  তারকামন্ডলীর আকৃতিকে সে কল্পনা করেছে বিভিন্ন প্রাণীর চেহারায়।  রাশিচক্রে তাই প্রাণীর  আধিক্য এতো বেশি।‌ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রেটিসের মনে হয়েছিল, মহাশূন্যের ওপারে অসংখ্য ছোট বড়ো জগৎ রয়েছে, তার কোনো কোনোটিতে প্রাণের স্পন্দন থাকতেও পারে। এর চারশো বছর পর রোমান দার্শনিক ও কবি লুক্রেটিয়াস অন‍্য জগতের কথা লিখেছিলেন। সেখানে  ভিন্ন ধরণের মানুষ এবং প্রাণীর কল্পনাও তিনি করেছিলেন।  

মহাবিশ্বে মানব সভ্যতার চেয়ে উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। প্রচুর কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে ভিন্ন গ্রহের প্রাণীদের নিয়ে।‌ সপ্তদশ শতাব্দীতে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেপলার মহাশূন্যে অভিযানের এক গল্প লিখলেন। তাঁর গল্পের অভিযাত্রীরা চাঁদে গিয়ে বিচিত্র সব সরীসৃপের পাল্লায় পড়েছিলো। ওটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম  বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী। ওই শতাব্দীরই শেষদিকে  ডাচ গণিতজ্ঞ ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্স একটি বই লিখলেন অন্য গ্রহে প্রাণের সম্ভবনা নিয়ে।  

১৮৯৪ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লয়েল তাঁর টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষন করতে গিয়ে  অদ্ভুত এক ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তিনি দেখলেন, মঙ্গলের বুকে আড়াআড়ি কিছু দাগ দেখা যাচ্ছে। তাঁর মনে হলো, এগুলো প্রাকৃতিক নয়, বরং এগুলো মঙ্গলগ্রহের "অধিবাসীদের" সৃষ্টি করা খাল। তিনি বললেন, এগুলো তারা কৃষিকাজের জন্য তৈরী করেছে। সে সময় পার্সিভালের ধারণাটি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।  পরবর্তীতে অবশ্য আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ফলে তাঁর ধারণাটি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়।  

পৃথিবী ছাড়াও অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে এটা অনেক প্রাচীন ধারণা।  বিংশ শতাব্দীতে এসে এই প্রাচীন ধারণাটি একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি লাভ করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন মহাকাশে নভোযান পাঠাচ্ছে। ‌চাঁদ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে শিলাখণ্ড। মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়েছে একাধিক রোবোটিক যান। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহেই মানুষের তৈরি করা নভোযান পৌঁছে গেছে। ‌ চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহে জমাট পানির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতেও  পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অনেক উল্কাখন্ডের মধ্যে  অ্যামাইনো এসিড সন্ধান পাওয়া গেছে। শক্তিশালী অপটিক্যাল এবং রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আমাদের সৌরজগতের বাইরেও পৃথিবীর মতো আরো অনেক গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। মানুষ আস্তে আস্তে মহাবিশ্বকে বুঝতে শিখেছে, বুঝতে পেরেছে এর বিশালত্বকে। কিন্তু এত কিছুর পরেও পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়নি।  

কিন্তু বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়ার পাত্র নন। মহাকাশে প্রাণের সন্ধান অব্যাহত রয়েছে। এটা মূলত দু'ধরনের সন্ধান। প্রথমত তাঁরা দেখছেন, চাঁদ বা সৌরজগতের কোন গ্রহে কোন অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। দ্বিতীয়ত তাঁরা দেখছেন, সৌরজগতের বাইরে কোথাও কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে কিনা। বুদ্ধিমান প্রাণী যদি থাকে, তাহলে তারা সেখানে কি ধরনের সভ্যতা গড়ে তুলেছে সেটাও তাঁদের গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা মহাবিশ্ব এতই বিশাল যে সেখানে অনেক ধরণের উন্নত সভ্যতা থাকাটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীতে যে নিয়মে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে, সেটা খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্য গ্রহেও ঘটতে পারে। বিবর্তনের ধারায় সেখানে উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটাই স্বাভাবিক।  

১৯৬৪ সনে রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী‌ কার্ডাশেভ এক  অভিনব তত্ত্ব হাজির করলেন। ‌ তিনি বললেন, মহাবিশ্বে তিন ধরনের সভ্যতা থাকা সম্ভব। তিনি সভ্যতার শ্রেণীবিন্যাস করলেন শক্তি ব্যবহারের উৎস দিয়ে। তিনি বললেন, প্রথম ধরনের সভ্যতা তাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে যে পরিমান শক্তি তাদের গ্রহে এসে পৌঁছায় শুধু সেটুকুই ব্যবহার করে।  এর বাইরেও তারা এখনো যেতে পারেনি। ‌ দ্বিতীয় ধরনের সভ্যতা আরেকটু এগিয়েছে। তারা তাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে সরাসরি সমস্ত শক্তি আহরণ করতে পারে। আর তৃতীয় ধরনের সভ্যতা আরো বেশি উন্নত। তারা তাদের গ্যালাক্সির সমস্ত শক্তিকেই কাজে লাগাতে পারে। তাঁর এই শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে পৃথিবীর মানুষ এখনো সভ্যতা বিকাশের প্রাথমিক স্তরেও কিছুটা নীচে রয়েছে। বর্তমানে অবশ্য এই শ্রেণীবিন্যাসটাকে আরো বাড়িয়ে সাতটি স্তরে  নিয়ে যাওয়া হয়েছে।‌ সবচেয়ে উপরের স্তরে ধরা হয়েছে এমন এক সভ্যতাকে, যারা টাইম এবং স্পেসকে অতিক্রম করে মহাবিশ্বকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে সক্ষম। এসব ধারণা অবশ্য এখনও অনুমানের পর্যায়ে আছে, এর স্বপক্ষে কোন  প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।  

ষাটের দশকের শুরুতে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেক একটি সমীকরণের সাহায্যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কত সংখ্যক উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব থাকা সম্ভব সে সম্বন্ধে একটি চমৎকার ধারণা দিয়েছিলেন। একে বলা হয় ড্রেক সমীকরণ। এই সমীকরণে বেশকিছু স্থিতিমাপ বা প্যারামিটার রয়েছে। এগুলোর মান পরিবর্তন করে উন্নত সভ্যতার সংখ্যা সম্বন্ধে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই সংখ্যাটি কয়েক হাজার থেকে কয়েক মিলিয়নের মধ্যে যে কোনো সংখ্যা হতে পারে। 

অপর সভ্যতার সন্ধানে ফ্রাঙ্ক ড্রেক একটি সাহসী পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর রেডিও টেলিস্কোপটি তাক করলেন সূর্যের মতো সাইজের দুটো নক্ষত্রের দিকে। তাঁর টেলিস্কোপের ফ্রিকোয়েন্সি তিনি ঠিক করলেন ১৪২০ মেগাহার্টজে। শীতল হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে এই  ফ্রিকোয়েন্সিতেই রেডিও সিগন্যাল বের হয়। মহাবিশ্বে হাইড্রোজেনের প্রাচুর্য রয়েছে। সেজন্য তিনি ভেবেছিলেন কোন উন্নত সভ্যতা পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হলে এই ফ্রিকোয়েন্সিটাই বেছে নিবে। বলাই বাহুল্য ফ্রাঙ্ক ড্রেক তাঁর এই পরীক্ষায় সফল হননি। কিন্তু তাঁর এই পরীক্ষা থেকেই জন্ম নিয়েছে অপর সভ্যতা সন্ধানের  সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের  নাম  "সার্চ ফর এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স"।  সংক্ষেপে প্রজেক্ট সেটি ( Project SETI)।  এই প্রজেক্টের অধীনে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বিশাল বিশাল রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে  মহাকাশে তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে অন্যকোন সভ্যতা থেকে ভেসে আসা রেডিও সংকেত। কিন্তু নিশ্চিত করে কিছুই পাওয়া যায়নি। 

তবে ১৯৭৭ সনে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও টেলিস্কোপে ৭২ সেকেন্ডের একটি রহস্যময় রেডিও সংকেত ধরা পড়েছিলো। এই রেডিও সংকেতের উৎস ছিল স্যাজিটেরিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ। রেডিও সংকেতটির কম্পিউটার প্রিন্ট আউটের উপর সংশ্লিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লিখেছিলেন Wow!, বলাই বাহুল্য এই রেডিও সংকেতটি পেয়ে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলেন। এই রহস্যময় ওয়াও সংকেতের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা আজও দিতে পারেনি। যদিও এ ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। ‌বিজ্ঞানীরা ইদানিং অবশ্য রেডিও সংকেতের পাশাপাশি লেজার রশ্মিরও সন্ধান করছেন। কিছু কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা মহাবিশ্বের উন্নত সভ্যতা লেজার রশ্মি‌ দিয়েও আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারে।  

২০১৬ সালে ইউরি মিলনার নামে একজন বিলিওনিয়ার শিল্পপতি এবং উদ্যোক্তা ব্রেক থ্রু লিসেন (breakthrough listen) নামে  ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। এই প্রজেক্টের আওতায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাশূন্যের বিভিন্ন অংশে তন্নতন্ন করে অপর কোন সভ্যতা থেকে ভেসে আসা বেতার তরঙ্গের সন্ধান করা হচ্ছে।   

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে এই প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের পার্কস রেডিও টেলিস্কোপে তাঁরা একটি রহস্যময় রেডিও সিগন্যাল রেকর্ড করেছেন। এই রেডিও সিগন্যালটির ফ্রিকুয়েন্সি ছিল ৯৮২.০০২ মেগাহার্জ। ‌সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই সিগন্যালটি এসেছে সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টারাই থেকে। বিজ্ঞানীরা জানেন, এই নক্ষত্রটিকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে একটি গ্রহ, যার নাম হলো প্রক্সিমা বি। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব হলো সাড়ে চার আলোকবর্ষ। এই  সিগন্যালটি মাত্র একবারই পাওয়া গেছে। সেজন্য এই সিগন্যালটি আদৌ কোন "টেকনো সিগনেচার" ছিল কিনা, সে সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।‌ 

মানুষ আদৌ তার আন্তঃনাক্ষত্রিক সাথীকে খুঁজে পাবে কিনা সেটা বলা মুশকিল। আর পেলেও সেই যোগাযোগের কারণে মানব সভ্যতাই আমূল বদলে যাবে কিনা কে বলতে পারে? তবে মহাবিশ্বের অন্য কোনখানে যে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। খ্যাতিমান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান বলেছিলেন, এত বড় মহাবিশ্ব যদি শুধু আমাদের জন্যই হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে স্পেসের বড়ই অপচয় হয়েছে। তাঁর মতে, অপর সভ্যতার সন্ধান পাওয়াটা শুধু মাত্র সময়ের ব্যাপার। এটি হবে মানব সভ্যতার জন্য এক বিশাল সন্ধিক্ষণ। 

 ©  তানভীর হোসেন

Comments