কপ ২৬ এর সাফল্য ও ব্যর্থতা

২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ নেট জিরোতে নামিয়ে আনার ব্যাপারে কপ ২৬ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ দেশ সম্মত হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সকল দেশের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশেষত তিনটি দেশ, চীন, ভারত এবং রাশিয়া এ ব্যাপারে পিছিয়ে রয়েছে। চীন বলেছে তারা ২০৬০ সালের মধ্যে নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায়। রাশিয়া বলেছে, তারাও ২০৬০ সালের মধ্যে নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে। 
তবে ভারত বলেছে তাদের আরো বেশি সময় লাগবে, তারা  ২০৭০ সালের মধ্যে  নেট জিরো সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। চীন, ভারত এবং রাশিয়া এই তিনটি দেশ একত্রে পৃথিবীর প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। সেজন্য এই তিনটি দেশ যদি এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকে তাহলে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ সেন্টিগ্রেডে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে কিনা এ ব্যাপারে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ‌ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা যদি দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি বেড়ে যায় তাহলে এই শতাব্দী শেষ হবার আগেই সারা পৃথিবী জুড়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাবে। এর ফলে মানব সভ্যতা বিপর্যস্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। 

তবে আশার কথা হলো, প্রাকৃতিক বনভূমি রক্ষা করার জন্য ১০০ টি দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ‌ এই দেশগুলোতে পৃথিবীর শতকরা ৮৫ ভাগ বনভূমি রয়েছে।  দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনভূমির দেশ ব্রাজিল বলেছে, তারা এই দশকের মধ্যেই আমাজনের জঙ্গলে গাছ কাটা বন্ধ করে দিতে চায় এবং নতুন করে বনায়ন করতে চায়। এটি অবশ্যই একটি শুভ উদ্যোগ। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। 

দক্ষিণ আমেরিকার আরেকটি দেশ ইকুয়েডর বলেছে, তারা জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর গ্যালাপোগাস দ্বীপের সংরক্ষিত এলাকা আরো বৃদ্ধি করবে। এর ফলে জীব বৈচিত্র্য বিকাশের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

আন্তর্জাতিক সহায়তার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। চল্লিশটি শিল্পোন্নত দেশ বলেছে, তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নেট জিরো  কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কারিগরি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে কাছ থেকে ৮.৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহযোগিতা পাবে। 

COP26 এর আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো, কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের পাশাপাশি মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারেও ১০০ টি দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। এসব দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ শতকরা ৩০ ভাগ কমিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

এছাড়া ৪৫ টি দেশ কৃষি ক্ষেত্রে গ্রীন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। তারা প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার পুনর্গঠন করে নবায়নযোগ্য কৃষি উৎপাদনের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ ব্যাপারে গবেষণাকে তারা উৎসাহিত করবে। 

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি বিশাল সমস্যা। এটি উপলব্ধি করে ১৯০ টি দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসতে চাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী দশকের মধ্যেই পৃথিবীর অনেক দেশই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেবে। ২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ কয়লা থেকে আর বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এ ব্যাপারে চীন, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া বলেছে,  বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিবে। তবে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, সেই বিদ্যুৎ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে তার ব্যাখ্যা জানা যায়নি। 

মোদ্দা কথা হলো, ভাল এবং মন্দ মিলিয়ে কপ ২৬ এর অর্জন একেবারে কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্যারিস চুক্তির পর এই প্রথম জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে এটাই  শেষ কথা নয়। এটা হলো শুরু। ভবিষ্যতে এভাবেই  পারস্পরিক আলোচনা এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে মানুষ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা আশা করতে পারি। এই ভয়াবহ সমস্যাটি যেহেতু মানুষ নিজেই  সৃষ্টি করেছে, এর সমাধানের ভারও কিন্তু মানুষের উপরই বর্তায়। এর কোনো বিকল্প নেই।

Comments