আমাদের বাসভূমি পৃথিবী সৌরজগতের অন্যতম একটি গ্রহ। সূর্যের কক্ষপথে পৃথিবীর অবস্থান হলো তৃতীয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে বুধ এবং শুক্র গ্রহ। পৃথিবীর পরে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে মঙ্গল গ্রহ। তারপর পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বৃহস্পতি গ্রহ।
কিন্তু মঙ্গল এবং বৃহস্পতি এ দুটো গ্রহের কক্ষপথের মাঝখানে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। এই দুই গ্রহের মাঝে আর অন্য কোন গ্রহ নেই। কিন্তু এখানে রয়েছে অসংখ্য গ্রহাণু। ইংরেজিতে এদের বলে
অ্যাস্টারয়েড (asteroid)। এসব গ্রহাণুগুলো ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হিসেবে ১.১ থেকে ১.৯ মিলিয়ন গ্রহাণু রয়েছে যেগুলোর দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটারের চেয়ে বেশি। আরো কয়েক মিলিয়ন গ্রহাণু রয়েছে যেগুলোর দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটারের চেয়ে অনেক কম। ছোট-বড় এসব গ্রহাণু ছড়িয়ে রয়েছে মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাঝামাঝি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন অ্যাস্টারয়েড বেল্ট (asteroid belt)।
সৌরজগত সৃষ্টির আদি লগ্নে কোন বিশেষ কারনে মঙ্গল এবং বৃহস্পতির গ্রহের মাঝখানে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রহ সৃষ্টি হতে পারে নি। গঠিত হতে না পারা এই গ্রহটির আদি উপাদানই গ্রহাণু হিসেবে ছড়িয়ে আছে সমগ্র অ্যাস্টারয়েড বেল্ট জুড়ে। সেজন্য গ্রহাণুদের নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের রয়েছে অপার কৌতুহল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্রহাণুদের গঠন বিশ্লেষণ করলে সৌরজগতের আদি অবস্থা সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।
বড় বড় গ্রহ গুলো সৃষ্টির পর সৌরজগতের আদি উপাদানগুলো নানা ধরনের ভৌত রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ছোট ছোট গ্রহাণুদের ক্ষেত্রে সে ধরনের পরিবর্তন হয়নি। সেজন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সৌরজগতের আদি অবস্থা সম্বন্ধে জানতে হলে সরাসরি গ্রহাণু থেকে পদার্থের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত মনে হলেও বাস্তবে সেটাই করেছেন জাপানের মহাকাশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা। বিজ্ঞান এবং কারিগরি প্রকৌশলে জাপান অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু তাঁরা ঠিক কতখানি এগিয়ে আছে সেটা হাতে-কলমে সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে জাপান অ্যারোস্পেইস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির (JAXA) মহাকাশ বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে JAXA মহাকাশে একটি নভোযান পাঠিয়েছিল। এই নভোযানের নাম হলো হায়াবুসা-২ ( Hayabusa 2 )। জাপানি ভাষায় হায়াবুসা মানে হলো এক ধরনের ফ্যালকন বা বাজপাখি। হায়াবুসা-২ এর প্রাথমিক মিশন ছিল, রাইউগু (Ryugu) নামের একটি গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া।
উপবৃত্তাকার পথে তিন বিলিয়ন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ২০১৮ সালের জুন মাসে হায়াবুসা ২ পৌঁছে যায় রাইউগু গ্রহাণুটির কাছাকাছি। তারপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হায়াবুসা-২ মহাকাশযানটিকে আলতোভাবে গ্রহাণুটির উপরে সফলভাবে অবতরণ করানো হয়। মহাকাশযানটি গ্রহাণুটির উপর থেকে ধূলিকণার নমুনা সংগ্রহ করার পর একে সরিয়ে এনে কাছাকাছি একটি হোল্ডিং পজিশনে রাখা হয়। এর পাঁচ মাস পর হায়াবুসা-২ কে আবারো সফলভাবে নামানো হয় রাইউগুর উপর। এবার হায়াবুসা-২ গ্রহাণুটির মাটির নিচ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। এসব নমুনার পরিমাণ অত্যন্ত সামান্য হলেও এর বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব অপরিসীম।
গ্রহাণু থেকে সংগৃহীত ধূলিকণা একটি ক্যাপসুলে ভরে সম্প্রতি পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। হায়াবুসা-২ ফিরতি পথে পৃথিবীর দুই লক্ষ কুড়ি হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ক্যাপসুলটি পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছে। গত বছরের (২০২০) ৭ ডিসেম্বর, ক্যাপসুলটি প্যারাশুটের সাহায্যে নিরাপদে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে নেমে এসেছে। সেখান থেকে ক্যাপসুলটি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য জাপানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রহাণুর নমুনা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের প্রাথমিক অবস্থার অনেক তথ্য পাবেন বলে আশা করছেন। এসব নমুনার ভেতরে কোন জৈব অণু আছে কিনা সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হবে।
মজার ব্যাপার হলো, হায়াবুসা-২ এর মিশন কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। তার আরো কাজ বাকি রয়েছে। ২০২৬ সালে মহাকাশ যানটি পৌঁছাবে আরেকটি গ্রহাণুর খুব কাছাকাছি। এই গ্রহাণুর নাম হলো CC 21। একে হায়াবুসা-২ খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবে, ছবি তুলবে। তারপর দীর্ঘ পথ ধরে উড়ে যাবে আরেকটি গ্রহাণুর কাছে, এর নাম হলো 1998 KY 26। এটি একটি ছোট কিন্তু খুব দ্রুত ঘূর্ণায়মান গ্রহাণু। হায়াবুসা-২ যখন এর কাছে পৌঁছবে তখন ২০৩১ সাল হয়ে যাবে। হায়াবুসা-২ এই গ্রহাণুটিকেও খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। এসব নিবিড় পর্যবেক্ষণের ফলে গ্রহাণুর গঠন সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা অনেক নূতন তথ্য ও উপাত্ত পাবেন বলে আশা করছেন। এর ফলে ভবিষ্যতে কোন গ্রহাণুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দিলে সে ব্যাপারে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করাটাও সহজতর হবে।
গ্রহাণু অভিযানের ক্ষেত্রে নাসার (NASA) বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে নেই। গত বছরের অক্টোবর মাসে নাসার OSIRIS-REx মহাকাশযান বেনু (Bennu) নামের একটি ছোট্ট গ্রহাণু থেকে সামান্য পরিমাণ নমুনা সংগ্রহ করেছে। এই নমুনা ২০২৩ সালে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন ২১৭৫ থেকে ২১৯৯ সালের মধ্যে বেনু নামের এই গ্রহাণুটির সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ হওয়ার একটি ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং এর গঠন সম্বন্ধে জানা থাকলে, আগেভাগেই একে ধ্বংস করা সহজ হবে।
এ বছরের অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখে নাসা (NASA) মহাকাশে উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে লুসি (Lucy) নামে একটি নতুন মহাকাশযান। এর কাজ হবে বৃহস্পতির গ্রহের কাছাকাছি অবস্থিত সাতটি বড় সাইজের গ্রহাণুকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা। লুসির মিশনের স্থায়িত্ব হবে বারো বছর। এই দীর্ঘ সময়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ঐ গ্রহাণুগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাবেন। এর ফলে এদের গঠন সম্বন্ধে তাঁরা অনেক নতুন তথ্য পাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
এরপর এ বছরের ২৪ নভেম্বর, ডাবল এস্টারয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট, সংক্ষেপে ডার্ট (DART), নামে আরেকটি মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে নাসা। এর কাজ হবে, ২০২২ সালে ডাইডায়মস নামের একটি জোড়া গ্রহাণুকে আঘাত করে এর গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করা। এটি সফল হলে, ভবিষ্যতে মানুষ গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করার মত আরও নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারবে বলে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। কিন্তু তারা মনে করেন, এর জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক আরো সহযোগিতা দরকার হবে। সেই লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থার বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন ।
সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহে মহাকাশযান পাঠানোর পাশাপাশি বর্তমান যুগের বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা বিভিন্ন গ্রহাণুতেও অভিযান চালানোর মতো প্রযুক্তি অর্জন করতে পেরেছেন। আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে মানুষ আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে সেটা অবশ্যই আশা করা যায়।
Comments