ফিরে দেখা: সবুজ বিপ্লব

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে কৃষি ক্ষেত্রে দুটো যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিলো। এর ফলে, আমাদের উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই খাদ্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়। অনেকে একে বলেন, সবুজ বিপ্লব বা গ্রীন রেভুলেশন। আসলে ঠিক কি ঘটেছিল সেই সময়? চলুন ফিরে যাই ষাটের দশকে। দেখে আসি ঘটনা দুটো। 

সেই সময় মেক্সিকোতে বসে আন্তর্জাতিক গম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা গমের ফলন বাড়ানোর জন্য গবেষণা করছিলেন। তাঁরা দেখলেন, গমের গাছ গুলো বড্ড বেশি লম্বা। ফলন বাড়ানোর জন্য সার দিলে গাছ গুলো নুয়ে পড়ে। এতে হিতে বিপরীত হয়। ফসল তোলাটাই তখন সমস্যা হয়ে  দাঁড়ায়। ফলন কমে যায়। তাঁরা ঠিক করলেন, খাটো জাতের গমের গাছ উদ্ভাবন করতে হবে। তাহলে ফলন বেশি হলেও গাছ দাঁড়িয়ে থাকবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। কোমর বেঁধে নামলেন তাঁরা খাটো জাতের গম গাছের সন্ধানে। যাকে বলে একেবারে গরু খোঁজা। "গবেষণা" শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে ব্যাপারটা অবশ্য সেটাই দাঁড়ায়। খুঁজতে খুঁজতে একদিন তাঁরা পেয়েও গেলেন বামন জাতের সেই কাঙ্খিত গম গাছ। নাম তার 'নোরীন ১০'। গমের এই জাতটি জাপানী বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছিলেন সেই ১৯৩৫ সালে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ডামাডোলে এর কথা  সবাই ভুলেই গিয়েছিলো। মাত্র দু'ফুট লম্বা এ জাতটি হাতে পেয়ে আন্তর্জাতিক গম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তাঁরা 'নোরীন ১০' জাতটি তাঁদের ব্রিডিং প্রোগ্রামে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করলেন অনেক গুলো উচ্চ ফলনশীল খাটো গমের জাত। সার দিলেও এসব নতুন জাতের গম গাছ হেলে পড়েনা, বরং প্রচুর ফলন দেয়। এসব জাতের গম বীজ আমাদের উপমহাদেশে আমদানি করে চাষাবাদ করা শুরু হলো। তাতে আশাতীত ফল ও পাওয়া গেল। গমের ফলন বেড়ে গেল বেশ কয়েকগুণ। এভাবেই ষাটের দশকে গমের ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিলো। যে বিজ্ঞানীটি এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁর নাম ড: নরম্যান বরলোগ। তাঁকে বলা হয়, সবুজ বিপ্লবের জনক। ‌ক্ষুধা মুক্তির আন্দোলনে অপরিসীম ভুমিকা রাখার জন্য ১৯৭০ সালে তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছিলো। 

এতো গেল গমের কথা। ষাটের দশকের শুরুতে ধানের ফলন নিয়েও ব্যাপক গবেষণা চলছিলো ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে। ধান বিজ্ঞানীদেরও একই ধরনের সমস্যা ছিল গাছের উচ্চতা নিয়ে। ধান গাছ লম্বা হলেই নুয়ে পড়ে। ফলন কমে যায়। তাঁরাও সমাধান খুঁজে পেলেন একটি খাটো জাতের ধানের মধ্যে। চাইনিজ এই জাতটির নাম হলো 'ডি-জী-উ জেন'। এই খাটো জাতের ধানের সাথে ইন্দোনেশিয়ার 'পেটা' নামের একটি লম্বা জাতের ধানের সংকরায়ণ করে তাঁরাও উদ্ভাবন করলেন উচ্চ ফলনশীল খাটো জাতের ধান, 'আই আর ৮' (IR8)। এখানে বলে রাখি, ইন্দোনেশিয়ার 'পেটা' নামের ধানের জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছিলো আমাদের দেশের স্থানীয় ধানের জাত 'লতিশাইল' এবং একটি  চাইনিজ ধানের জাতের মধ্যে সংকরায়ণ করে। পরীক্ষা করে দেখা গেল প্রচলিত ধানের চেয়ে 'আই আর ৮' এর ফলন কয়েকগুন বেশি। এজন্য 'আই আর ৮' ধানকে অনেকে বলেন, মিরাকেল রাইস। আমাদের উপমহাদেশে 'আই আর ৮' ধানের বীজ আমদানি করে ব্যাপকহারে চাষাবাদ শুরু করা হলো। এই উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করে ধানের উৎপাদন কয়েক গুন বেড়ে গেল। ষাটের দশকে এভাবেই ধানের ক্ষেত্রেও সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিলো।‌ আমাদের দেশে 'আই আর ৮' এর নাম হয়ে গেল ইরি ধান। এর কারণ, ইরি (IRRI) হলো ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সংক্ষিপ্ত নাম। 'আই আর ৮' ধান উদ্ভাবনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন ইরির সেই সময়কার রাইস ব্রিডার পিটার জেনিংস এবং হ্যাঙ্ক বিচেল। যদিও ধান বিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়নি, কিন্তু বিশ্ব ক্ষুধা মুক্তির আন্দোলনে তাঁদের অবদান গম বিজ্ঞানীদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। 

এভাবেই ষাটের দশকে গম ও ধানের ক্ষেত্রে এ দুটো যুগান্তকারী উদ্ভাবন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে টেকসই করেছিলো। 

© Tanvir Hossain

Comments